Saturday, August 16, 2014

সূর্যগ্রহণ ও ছেঁড়া পরোটা

কিছু কিছু মানুষ বিজ্ঞানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হন। স্কুলের স্যারেরা পড়তে বলেছেন বলেই সায়েন্স পড়েছেন অথবা মাধ্যমিকে বেশী নম্বর পেয়েছেন বলেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছেন এরকম নন। মাধ্যমিক ব্যাপার’টা অবশ্য উঠে যাচ্ছে (বা গেছে)।

এরকম একজন মানুষ হলেন আমার বাবা। আমার বাবা বৈজ্ঞানিক নন, কিন্তু নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কিনে ফেলা এবং অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার বাবার স্বভাব। বহুদিনের স্বভাব।

ক্লাস সিক্সের আমি একজোড়া ওয়াকিটকির একটা নিয়ে ডক্টর’স কোয়ার্টারের সামনের মাঠ পেরিয়ে একদম শেষে চলে গেছি। তিনতলার কোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবা অন্য ওয়াকিটকিটায় জোরে জোরে বলে যাচ্ছে, “শোনা যাচ্ছে? কি রে, শুনতে পাচ্ছিস? দোকানে বলেছে মিলিটারি গ্রেড। এক কিলোমিটার অব্দি কাজ করবে।”

শোনা যাচ্ছে, এবং আমি প্রাণপণ চেল্লিয়ে (যদিও দরকার ছিল না, ওয়াকিটকি কাজ করছিল) সেটা জানান দেওয়া মাত্র নির্দেশ এলো – আরো দূরে যা। মুশকিল হচ্ছে আড়াআড়িভাবে মাঠ পেরোনোর পরে কচুরিপানার জঙ্গল।

মফস্বল থেকে এটাও উঠে যাচ্ছে। মশার যেমন গুড নাইট, কচুরিপানার প্রোমোটার।

যাগ্‌গে, কার্গিলে কম্যান্ডারকে পরিস্থিতি জানানোর মত তৎপরতায় (স্যালুট ছাড়া) বাবাকে জানালাম যে আর এগোনো সম্ভব নয়। সামনে ওয়াটার ফ্রন্ট।

"হুম্‌, তাহলে আর কি। ফেরত চলে আয়। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ হল কি বলিস ... বেতার ফোন। তুই এবার পাড়ার মধ্যে কোথাও গেলে এটা নিয়ে যাবি। মুদীর দোকানে গিয়ে কত গ্রাম বেগুন মনে না পড়লেই মাকে ওয়াকিটকিতে - ওভার অ্যান্ড আউট।"
বলা বাহুল্য – ঘটনা আর এগোয় নি। ওয়াকিটকির সেই শুরু আর সেই শেষ – পঁচানব্বই সালে কেনা সাত হাজার টাকার ওয়াকিটকির প্রথম ও শেষ ব্যবহার।

ওই সময় নাগাদ আরেকটা ব্যাপার ঘটেছিল, যেটা এক্ষুণি লিখে ফেলা দরকার। সূর্য গ্রহণ। পূর্ণ গ্রহণ।

ডায়মন্ড রিং বলে একটা ব্যাপার দেখা যাবে যেটা জৌলুসে পি সি চন্দ্র কে বলে বলে দশ গোল দেবে।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল সেই অঙ্গুরীয় আমাদের খড়দার কোয়ার্টারের ছাদ থেকে দেখা যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে বারুইপুর হচ্ছে এই শো’র ব্যালকনির সিট। খড়দা থেকে গ্রহণ দেখা নিশ্চয়ই যাবে, কিন্তু ওই ড্রেস সার্কেল মার্কা দেখা হবে।

সুতরাং শুভ দিনে আমরা মেন লাইনের ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ এবং সাউথের ট্রেন পাকড়ে বারুইপুর চেপে এলাম। ট্রেনে আসা শুধু মাত্র সুবিধেজনক ছিল না, বাধ্যতামূলক ছিল। কারণ আমার চারচাকা সংক্রান্ত মোশন সিকনেস।

ক্লাস নাইন অব্দি আমার একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল – বাসে উঠে ঠিক সাত মিনিটের মাথার হড়হড় করে বমি করা। উইদাউট ফেলিওর। ওপেন করে সচিনের সেঞ্চুরির মত। বা ক্লাবের হয়ে মেসির গোল করার মত। তার থেকেও নির্ভুল, নিশানায় অভ্রান্ত।

পেটে খাবার নেই, মানে বাড়ি থেকে না খাইয়ে আনা হয়েছে ব্যাপারটা আটকানোর জন্য। কোই পরোয়া নেই, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে বেরোনো হর্মোনগুলো, আমার পাকস্থলী সার্চ করে কিছু না পেয়ে পিত্ত তুলে আনত। সেই প্রথম জানা পিত্তি জ্বলে যাওয়া কাকে বলে। আক্ষরিক অর্থে।

শুরুর দিকে বাবা-মা কি করে সামলাতেন সেটা আমার মনে নেই। ক্লাস ওয়ান-টু থেকে যেটা শুরু হয়েছিল – বাসে উঠেই মা জানালার ধারে বসা কাকু-কাকিমাকে বলতেন, “ওকে জায়গাটা ছেড়ে দেবেন প্লিজ, মোশন সিকনেস আছে। একটু পরেই বমি করবে।” কেউ কেউ বিশ্বাস করে, দয়া-পরবশ হয়ে ছেড়ে দিতেন। আর যাঁরা দিতেন না, মা তাঁদেরকে সতর্ক করতেন, “দেখুন ও কিন্তু সত্যিই করবে, জানলার পাশে বসলে বাসের বাইরে, নইলে ......”
এই পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষ অসম্পূর্ণ কথার মানে বুঝতে পারেন না। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখেছি তাঁরা পস্তান। এক্ষেত্রেও অন্যথা হত না। তাঁরা গোঁ ধরে জানলার ধারে বসে থাকতেন। এবং ঠিক ছয় মিনিট বাদে (কথাবার্তায় এক মিনিট কেটে গেছে) ব্যাপারটা ঘটত।

বহু অভিশাপ সংগ্রহ করেছি আমি এই পদ্ধতিতে। পার্টিতে মদে অচেতন বন্ধু/বান্ধবীকে উদ্ধার করার সময় একটা একটা করে অভিশাপ কাটাই। কিন্তু জন্ম থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত সব অভিশাপ কাটাতে গেলে আমাকে যে পরিমাণ পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হবে, সেটা ঠিক ...

বেশ খানিকটা বাজে বকে দিলাম। ব্যাক টু বারুইপুর। বিজ্ঞান সংসদের চশমা জোগাড় করে হয়েছে সূর্য গ্রহণ দেখার জন্য। কিন্তু চশমা’টা কি সত্যিই পর্যাপ্ত পরিমাণে কালো? মানসিক শান্তির জন্য শেষ মুহূর্তে হাসপাতালের নষ্ট হওয়া নিকশ কালো এক্স রে প্লেটেই ভরসা রাখা হল।

তারপর দেখা গেল – ডায়মন্ড রিং। কালো এক্স রে প্লেটের মধ্যে দিয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়া আকাশকে আরো কালো করে দিয়ে, হঠাৎ চারপাশে ঝটফটিয়ে পাখি উড়ে যাবার শব্দ। কিন্তু ওই বিশেষ দিনটির কথা আমার হীরের আংটির জন্য মনে নেই।

মনে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া পরোটার জন্য।

আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ছোটোবেলা থেকে চারপাশ দেখেই সেই ধারণা গড়ে উঠেছিল – পরোটা সংখ্যা গুণে বিক্রী হয় – এবং অর্ধেক বা ছেঁড়া বিক্রী হয় না। এটা যেন একটা থিওরেম। পরোটা থিওরেম।

আংটি দেখে যখন আমি আর বাবা বারুইপুর স্টেশনে তন্নতন্ন করে খাবার-দাবার খুঁজছি – তখন দেখা গেল রাশি রাশি পরোটা ছিঁড়ে ওজন করে বিক্রি হচ্ছে। রীতিমত দাঁড়িপাল্লার একদিকে ওজন আর অন্যদিকে পরোটা। পরোটার দিকে ওজনে বেশী হয়ে গেছে। দোকানি একটু ছিঁড়ে কমিয়ে দিলেন।
আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমি আর বাবা মিলে তিনশো (গ্রাম) পরোটা খেয়েছিলাম। আমার পরোটা থিওরেম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছিল।

ঠিক পরের স্কুলের বাংলা পরীক্ষায়, রচনায় তিনটে অপশন ছিল - রবীন্দ্রনাথ, বর্ষাকাল আর সূর্য গ্রহণ। সেফ রবীন্দ্রনাথ এবং ততোধিক সেফ বর্ষাকাল ছেড়ে সূর্য গ্রহণের মুখোমুখি হয়েছিলাম – ভালো নম্বরের আশায়। আনকমন টপিক লিখলে স্যারেরা বুঝতেন যে খাতায় উগরে দেয় নি, নিজে লিখেছে। নম্বরটাও ঢেলে দিতেন।

কিন্তু তিন পাতার রচনার মধ্যে এক পাতা পুরোটাই ছেঁড়া পরোটার বর্ণনা থাকায় স্যার রচনায় ভালো নম্বর দিতে পারেন নি। ডেকে বলেছিলেন, “দ্যাখ্‌ পরোটার সাথে সূর্য গ্রহণের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তুই লিখেছিস্‌ ভালোই, কিন্তু তাও নম্বর দিতে পারলাম না!”

আজো পৃথিবীর যে কোনো কোথাও, অথবা ইন্টারনেটে সূর্য গ্রহণের ছবি দেখলেই আমার মনে পড়ে – শরতের পেঁজা তুলোর মতন নরম ছেঁড়া ছেঁড়া পরোটা।

Thursday, August 7, 2014

মগ্নমৈনাক

(১)

মৈনাক আজ অনেক দিন পরে স্কুলের পাড়ায় এসেছেন। প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেল।
তখন মৈনাকরা ভাড়া থাকতেন। একটা দোতলা হলুদ রঙচটা বাড়ির একতলায়। এই তো সেদিনকার কথা। টেস্ট দিয়ে হই হই করতে করতে বাড়ি গেলেন। টেস্টের পরে টানা তিনমাস ছুটি। বাড়ি বসে পড়তে হবে। তারপর মাধ্যমিক।

তি--ন--মা--স।

ভাবা যায়? গরমের সময় একমাস ছুটি ছাড়া স্কুল জীবনে এতোটা টানা ছুটি তো বলতে গেলে পাওয়াই যেত না।
টানা এক মাস ছুটি - সেটাকে কম মনে হত।

সত্যি? …… এরকম জীবন ছিল না কি কখনো?

অবিশ্বাসে ভরা চোখে স্কুল বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মৈনাক। ভ্রু কুঁচকে গেছে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো? ক্লাসরুমের সবুজ দরজা গুলোকে কি বিশাল মনে হত তখন। পাল্লাগুলো যেন ঘিরে ধরছে, দরজার ফ্রেমের ওপরের দিকটা তো ক্লাস সেভেন অব্দি লাফিয়ে ধরতে হত। তারপর গোড়ালিতে ভর দিয়ে। আচ্ছা, এখন ছুঁতে গেলে কেমন হত?

আজ তো ছুঁয়ে দেখা হবে না - শনিবার স্কুল বন্ধ, পরে একদিন উইকডে তে আসতে হবে। আসতেই হবে।

বাকেট লিস্ট।

টেস্ট দিয়ে অবশ্য মৈনাক সরাসরি বাড়ি যান নি। স্কুলের পরে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট-গল্প-আড্ডা সেরে স্কুল থেকে বেরিয়েছিলেন। হারকিউলিস সাইকেল, ঘন সবুজ রঙের। চেন কভার দেওয়া আছে। সিটের হাইট বাইশ ইঞ্চি থেকে বাড়িয়ে চব্বিশ ইঞ্চি করা হয়েছে। বাবার টোটকা। এতে নাকি ছেলে আরও চটপট লম্বা হবে।

মিথ। একদম ফালতু মিথ।
হাজার সাইকেলে চড়েও মৈনাক পাঁচ সাতের বেশি উঠতে পারেন নি।

বন্ধুদের শেষবারের মত টাটা করে মৈনাক হারকিউলিসের প্যাডেলে চাপ দিয়েছিলেন। দেরী হয়ে যাচ্ছিল। সাইকেলে চেপে, হ্যাঁ ওই বাঁদিকের রাস্তা দিয়েই প্রতিদিনের মত, এগোচ্ছিলেন। প্যাডেলে একটু জোরে চাপ।

স্কুলের পরে লাইব্রেরী, তারও দুটো গলি পরে বাবুনদের বাড়ি ছাড়িয়ে কথোপকথনের সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে থাকবে। মালতীবালা স্মৃতি বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের ছাত্রী ছন্দা।

আর কথোপকথন একটা এস টি ডি বুথ।

মারাত্মক পপুলার এস টি ডি বুথ। কাজের ফোন, অদরকারে ফোন, স্কুলের ফোন, কাজের মাসীর ফোন, আর সর্বোপরি প্রেমালাপের ফোন। সদা ব্যস্ত।
টেস্টের পরে দুজনের স্কুলেই ছুটি পড়ে যাচ্ছে, এর পর নিয়মিত দেখা করা যাবে না। তাই সেদিন স্পেশাল অ্যাপো। একটু বেশী সময় কাটানো।

প্ল্যান তাই ছিল। ইন ফ্যাক্ট, মৈনাক বেশ সুন্দর দেখতে কাঁথা স্টিচের মলাটের ডায়েরীর ভেতরে গোলাপ লুকিয়ে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

কিন্তু গড ডিজপোজ করলেন।

বৃষ্টি নেমে এলো। অঝোর ধারে। মৈনাক হাঁ করে বৃষ্টিতে ভিজছেন। কাঁথা স্টিচের ডায়েরীও ভিজছে।

অসময়ের বৃষ্টি।

কথোপকথন বন্ধ, সবুজ রঙের পিসিও, হলুদ রঙের এসটিডি আর লাল রঙের আইএসডি। এসটিডি লেখাটা বাঁদিকে কিছুটা উঠে গেছে। মৈনাকের জামা ভিজে সপ্‌সপ্‌। দুপুর বেলায় কে আর ফোন করতে আসে? সেই সন্ধ্যে হলে, যদি ঝড় থামে, তবেই কথোপকথন খুলবে।

দশ বারোটা বাড়ি পরে সুমনের বাড়ি - গেলেই হত। কিন্তু মৈনাক যান নি। কাকীমা যদি জিজ্ঞেস করে বসেন - এখানে কোথায় এসেছো মৈনাক?

মৈনাকদের বাড়ি তো রেললাইন পেরিয়ে সেই রবীন্দ্রপল্লীতে। পুরোটা উল্টোদিকে। কাকিমাকে কি জবাব দিতেন মৈনাক?

স্কুল গেটের সামনে দাঁড় করানো হণ্ডা সিটির ভেতরে আজকের মৈনাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শেষ কবে নিজের স্কুল বা কলেজের সামনে বৃষ্টিতে ভিজেছেন সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেও সে আশা পূর্ণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। দুর ছাই, বাকেট লিস্টে আর একটা আইটেম যোগ হল।

বায়োলজির স্যার জীবনবাবু পড়াতেন, যে প্রাণী জীবনধারণের জন্য অন্য জীবের ওপর ভরসা করে তাকে পরজীবী বলে। পরজীবি দুপ্রকার হয়, মিথোজীবী – আর ... আর একটা মনে পড়ছে না। স্কুলের জীবনটা বোধহয় মিথোজীবিতা ছিল, তাঁদেরও স্কুলকে প্রয়োজন, স্কুলেরও প্রয়োজন ছাত্রের।

সেদিন মৈনাক মিনিট দশেক সাইকেলে বসে থেকে, ভ্যাবলার মত ভিজে বাড়ি চলে এসেছিলেন। জানতে পারেন নি আরো কিছুক্ষণের মধ্যে, ছন্দা, বৃষ্টিতে রিকশা না পেয়ে জল ঠেলে ঠেলে কথোপকথনের সামনে হাজির হয়েছিল। চারদিন বাদে যখন জানতে পারলেন, তখন বড্ডো দেরি হয়ে গেছে। ছন্দা জ্বর-টর বাঁধিয়ে বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। মৈনাক ভয়ে ছন্দাদের বাড়িমুখো হন নি।

একজন বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ায় নি।

তারপর কালের নিয়মে মাধ্যমিক এল। চলেও গেল। অ্যাডিশনাল পরীক্ষার শেষে মালতীবালার সামনে থেকে ছন্দাকে পাকড়াও করলেন মৈনাক। ছন্দা এড়িয়ে যাচ্ছিল, মৈনাক’ই জোর করেছিলেন।

আবার সেই কথোপকথন। আবার সেই ফিসফিস।

- তুমি দেরী করে এসেছো, তাই আমায় দেখতে পাও নি। প্লিজ এটা নিয়ে আর রাগ কোরো না। লক্ষীটি, প্লিজ।
- ওই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসছি, দেরি তো হবেই ...... এসেছিলাম এই ঢের। তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে না কেন?
- ছিলাম তো, পাক্কা দশ মিনিট। আর কতক্ষণ থাকবো?
- তোমার তো সাইকেল, টুক করে এসেছো, আবার টুক করে চলে গেছো। আমি কি জানতে গেছি নাকি কখন এসেছো? আদৌ এসেছো কিনা?
- কি? ... আমি আসি নি? তুমি এটা বলতে পারলে? আমি মিথ্যে কথা বলছি?
- বলতেই পারো, তোমায় তো আর কম দিন দেখছি না।

ফিসফিস কখন হিসহিসে পরিণত হয়েছে, মৈনাক-ছন্দা টেরও পান নি। টের পাওয়ার কথাও নয়। হিসেব মেলানোর সময় কে আর অত ভাবে।

- ছন্দা আমি এসেছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোমার জন্য একটা কাঁথা স্টিচের ডায়েরি ......
- কি জানি বাবা, কিছুই বিশ্বাস নেই। তোমরা ছেলেরা কথায় কথায় ঢপ দিতে পারো।
- তাই যদি হয়, তাহলে দেখা না করলেই হয়। এতোই যদি অবিশ্বাস, তাহলে ......
- কে চেয়েছে দেখা করতে? আমি? না তুমি? টেনে টেনে আমাকে এখানে নিয়ে এলো কে? মৈনাক, আমার আর তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না ......
- প্লিজ ছন্দা, একটু ভাবো, মাধ্যমিক ছিল সামনে।
- আরে ... ভারী আমার মাধ্যমিক রে। নম্বর কি পাবে সেতো জানা আছে। আবার বড়ো বড়ো কথা।

খোকন’দা কথোপকথন থেকে মুখ বাড়ালো।
তোদের হয়ে গেলে জানাস। রঙের মিস্ত্রীকে খবর দিতে হবে।
কেন খোকনদা?

দোকানের নাম মুছে আবার লিখতে হবে, কথোপকথন চলবে না। ভাবছি নতুন নাম দেব।

কলহ।

তখনকার মত হেসে ফেললেও, মৈনাক টের পেয়েছিলেন একটা ধাক্কা। একটা জোর ধাক্কা। মনের মধ্যে একটা জেদ। সত্যিই তো লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র তিনি। পড়াশোনায় বরাবরই মোটামুটি। ছন্দা কিছু ভুল বলে নি। কিন্তু এত জনের সামনে বলল। কথাটা কি তাচ্ছিল্যের সাথেই না বলল। বিদ্রূপের হাসি মাখানো ছিল। খোকনদাও হাসছিল।
ছন্দাকে দেখিয়ে দিতে হবে। রেজাল্ট কাকে বলে সেটা ছন্দাকে দেখিয়ে দিতে হবে।

তা দেখিয়েছেন বটে মৈনাক।

হায়ার সেকেন্ডারি থেকে শুরু করে জীবনের পরের পরীক্ষাগুলোয় ক্রমাগত সাফল্যের ধাপ উৎরেছেন। ছন্দা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, নতুন সম্পর্ক। ভাঙ্গা-গড়া। মাল্টি-ন্যাশনাল অফিসে ঢুকে তরতর করে উন্নতি। অফিসের সহকর্মীর সাথে প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে।

ছন্দার সাথে আর কোনোদিন কথা বলা হয়ে ওঠে নি মৈনাকের। সত্যিটা হল মৈনাক কথা বলেন নি ইচ্ছে করে। ছন্দা অবশ্য ক্লাস ইলেভেনে, বারদুয়েক কমন বন্ধু মারফত যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন।

আহত মৈনাক কোনো উৎসাহ দেখান নি। শুধু একটা ভেজা কাঁথা স্টিচের ডায়েরি বন্ধু মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যস্‌।

ছন্দা কোনোদিন সেভাবে আর মৈনাকের জীবনে ফিরে আসেন নি। হায়ার সেকেন্ডারিতে জেলায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে কলকাতায় চলে এলেন।
ক্লাস নাইন-টেনের ‘দুরন্ত’ প্রেম মৈনাকের জীবনে ব্যারাকপুর লোকাল হয়েই রয়ে গিয়েছে।

কলেজ-ইউনিভার্সিটির বাকি সম্পর্কগুলো মৈনাকের সেভাবে মনেও পড়ে না। কিন্তু মালতীবালা স্মৃতি বিদ্যালয়ের ছন্দা, ক্লাস টেনের বিনুনি বাঁধা ছন্দা, মানুষ মৈনাক’কে চিরকালের জন্য পালটে দিয়ে গেছে।

ইঁদুরদৌড়ের লাস্ট ল্যাপে, পাকা ম্যারাথন রানারের মত স্পিড বাড়িয়ে, প্রথম ঝাঁকটায় ঢুকে পড়েছেন মৈনাক। কুড়ি বছর আগের, ছন্দার সেই অপমানের বদলা নেওয়ার দৌড় এখনও চলছে। দৌড় থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখছেন না মৈনাক।

মৈনাক খুব মন দিয়ে ভেবে দেখলেন, সেই তুলনায় ছন্দার জীবনে তাঁর সেরকম কোনো ভূমিকাই নেই। থাকতে পারে না।

শুধু এক সেই বাল্যপ্রেম।

আর বাল্যপ্রেমে ...... সে তো সবাই জানে ......

(২)

হাঁটতে হাঁটতে কখন কথোপকথনের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন খেয়ালই ছিল না মৈনাকের। কিন্তু দোতলা বাড়িটার নীচতলায় কথোপকথন কই? এ তো মোবাইলের দোকান।

মৈনাক একটু উঁকি-ঝুঁকি মারলেন। ওই তো কে একটা বসে আছে। খোকনদা কি? হ্যাঁ, সেরকমই মনে হচ্ছে। খোকনদাই বসে আছে। মাথা ফাঁকা প্রায়। চেহারায় একটা হাল্কা সফল ব্যাবসায়ী জেল্লা চলে এসেছে, আর চোখে চশমা। দোকান ভালোই চলে মনে হয়, এসি চলছে। খুব দামী মোবাইল সেট নেই। কিন্তু দোকানে কাটতি আছে, সেটা লেটেস্ট মোবাইলের পসরা দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে।

দোকানের নামটা অবশ্য খোকনদা পালটায় নি। নিয়নের লাইট জ্বলছে - কথোপকথন।

বাকেট লিস্টে আরেকটা আইটেম যোগ হতে দেওয়া যায় না। মৈনাক ঢুকে পড়লেন। হেডফোনটা অনেক দিন ধরেই বেগড়বাঁই করছে, এমনিতেই কিনতে হত।

খোকনদা চিনতে পারল না। সেটাই স্বাভাবিক। মাধ্যমিকের পরে আর দু-বছর ছিলেন মৈনাক এই স্কুলে। কুড়িটা বছর চলে গেছে। আঠেরো আর আটত্রিশে যে বড্ডো বেশী তফাত।

একটা চলনসই হেডসেট কিনে মৈনাক নিজের পরিচয় দিলেন। খোকনদা প্রথমে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর হো হো করে হেসে ফেলল।

- সে কি রে, আপনি ... মানে ... তুই? কতদিন বাদে দেখলাম রে? তা প্রায় বছর কুড়ি হবে ... হবে না?
- হ্যাঁ, এক্স্যাক্টলি কুড়ি’ই। তোমার দোকানে তখন একটা এস টি ডি বুথ ছিল, সবাই খুব ফোন করতে আসত।
- ঠিক ঠিক, তারপরে একটা ইন্টারনেট কাফে করেছিলাম, জানিস। তদ্দিনে তোরা পাস করে চলে গেছিস। কিন্তু তাও শেষ দিকে আর চলছিল না, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ঢুকে পড়ল। এই বছর পাঁচেক হল, ওটা পালটে মোবাইলের দোকান দিলাম। তবে কি জানিস, দোকানের নামটা কিন্তু পাল্টাই নি একবার’ও। তো অ্যাদ্দিন বাদে হঠাৎ ...... স্কুল দেখতে এসেছিস তুই?
- হ্যাঁ, ওই ... আর কি।
- তা কেমন দেখলি?
- অনেক কিছুই পালটে গেছে খোকনদা। অবশ্য ... সেটাই স্বাভাবিক। আমিও তো অনেকটাই ...... তুমি কিন্তু অনেকটা এরকম আছো খোকনদা। আচ্ছা, আমাদের ব্যাচের আর কাউকে দেখো নাকি?
- না ... সেরকম কেউ তো এখানে আর থাকে টাকে না। মাঝে মধ্যে তোর মত কেউ আসে। তবে ...
- তবে কি?
- না মানেই, কাছেই একটা নতুন ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুল খুলেছে।
- আরে দূর, আমাদের সময় আবার ইংলিশ স্কুল কোথায়? তুমি আমাদের স্কুলের কথা বলো ......
- আরে শোনই না ...... ওই স্কুলটায় ছন্দার ছেলে পড়ে। ছন্দাকে দেখি, মাঝে মাঝে নিতে আসে। পাশের পাড়াতেই ছন্দার বিয়ে হয়েছে। ছেলেকে এই স্কুলটায় ভর্তি করেছে। আমাকে বিয়েতে বলেছিল। আমার কাছ থেকেই ফোন রিচার্জ করায়।

মৈনাক চুপ।

- কি রে, তোর মনে নেই? তোদের সাথেই তো পড়তো, নাকি আমি ভুল করছি? অ্যাতো বছরে তো আর কম স্টুডেন্ট পাস করল না।
- হ্যাঁ, মানে ... আমাদের সঙ্গেই ...
- দাঁড়া দেখি তুই একটু। ইংরিজী স্কুল। শনিবারও পুরো খোলা। একটু পরেই যাবে এদিক দিয়ে। দ্যাখ, চিনতে পারিস কিনা।

(৩)

খোকনদাই ডাকল – এই যে ছন্দা, ছন্দা – শোনো একবার এদিকে।
একটি ক্লাস থ্রি-ফোরের সাদা-নীল স্কুল-ড্রেস বাচ্চাকে নিয়ে ছন্দা হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটু অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন।

- কি হয়েছে, খোকনদা?
- এই দ্যাখো দেখি, একে চিনতে পারো নাকি?
মৈনাক চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মন দিয়ে ছন্দাকে দেখছিলেন। বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশিরানি। এরকম হচ্ছে কেন? কোথায় যেন শুনেছিলেন – সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লে কোনোদিন সেই ভালোলাগার অনুভূতি উবে যায় না। হাজার চেষ্টা করলেও না।

ফল্গু নদীর মত লুকিয়ে থাকে।

ছন্দা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল – কেমন আছো? এদিকে কোনো কাজে এসেছো?
- না, আসলে হঠাৎ করেই অনেকটা ...
- ভালোই তো, কোথায় আছো এখন?
- টেক্সাস ... মানে অফিসের কাজে।
- বাঃ, কাকু-কাকিমা কেমন? ভালো তো?
- হ্যাঁ বাবা-মা ভালোই আছেন, তোমার?
- হুম্‌ম্‌... বাবা-মা আছে, বেশ আছে। এ বয়েসে যেমন থাকার সেরকম’ই আছে।
- ছন্দা ... তোমার ছেলে?
- হ্যাঁ, লাল্টু ... যা দুরন্ত হয়েছে না।

মৈনাক লক্ষ্য করলেন, ছন্দা তাঁকে একবারও নাম ধরে ডাকলেন না। কাটা কাটা কথা। এতোটা অবহেলা, এতোদিন পরেও। মৈনাকের একটু কষ্ট হল।

লাল্টু একটু রাস্তার ওপারে এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিল। ভারী মিষ্টি ছেলেটি। সাদা জামা নীল হাফপ্যান্ট। ছন্দা কব্জিতে বাঁধা কালো হাতঘড়িটায় একনজর বুলিয়ে, ডেকে উঠলেন - লাল্টু, এদিকে এসো। বাড়ি যেতে হবে, দিদুন ফোন করেছিল। মেঘ করেছে, এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে।

মৈনাক হেসে তড়বড় করে কিছু একটা বলতে গেলেন, কিন্তু কথা খুঁজে পেলেন না। মাথায় একটাই পাক খাচ্ছে – এতোটা উপেক্ষা। প্রাপ্য ছিল তাঁর?
ছন্দা মৃদু বাধ্যবাধকতার হাসি হেসে মৈনাকের দিকে তাকালেন, আজ তাহলে এগোই। ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।

মৈনাক কিছুই ঠিক করে বলে উঠতে পারলেন না। আধখানা ঘাড় নাড়লেন।

ছন্দার সাথে দেখা না হলেই ভালো হত, নিজেকে খুব অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। সেই মাধ্যমিকের পরে, কুড়ি বছর ধরে, মেয়েটি কোনোদিন তার কথা ভাবেও নি। আজ যে দেখা হল, তাতেও তার ওপরে কোনো প্রভাব পরে নি। আজই হয়ত বাড়ি ফিরে স্বামীর সাথে এই ঘটনা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে।

ছন্দার হাত ধরে লাল্টু এগিয়ে যাচ্ছে। মৈনাক দেখছেন। কথোপকথনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। টুপটুপ করে ভারী ফোঁটার বৃষ্টি পড়ছে, একটা ফোঁটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে, গায়ে লাগছে না। পুরো ব্যাপারটা জলছবির মত লাগছে। মৈনাকদের ছোটোবেলায় পাওয়া যেত। খাতার ওপরে রেখে পেন্সিলের পেছন দিকটা দিয়ে ঘষলেই ম্যাজিকের মত ...... এখন কি আর পাওয়া যায়?

মৈনাক পিছু হাঁটছেন। স্কুলের সামনে বৃষ্টিতে ভেজা’টা যে বাকেট লিস্টে ছিল, মৈনাকের সেটা আর এখন মনে পড়ছে না।

(৪)

মোড় ঘোরার মুখে, মৈনাকের পাশ দিয়ে সাদা-নীল একটা তীর ছুটে গেল। লাল্টুর বয়েসী একটি ছেলে। একই স্কুলের হবে।

দৌড়োচ্ছে আর চিৎকার করছে - এই মৈনাক, মৈনাক, লাল স্কেচপেনটা, কালকে মনে করে নিয়ে আসিস কিন্তু।

মার হাত ধরে ছোট্টো মৈনাক ঘুরে তাকালো – ওকে, ওকে … সিওর আনবো।

মোড়ের ওপাশে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে আরেক মৈনাকের হঠাৎ জীবনবাবুর মুখটা মনে পড়লো –

আর এক ধরণের পরজীবী হয় - তাদেরকে বলে - মৃতজীবী।