Wednesday, December 14, 2022

দেশে বিদেশে ফুটবল

 (১) পাওলো আর অ্যামান্ডার গল্প




মাস্টার ডিগ্রী চলাকালীন একটি ব্রাজিলের ছেলে, নাম পাওলো, আমাদের সাথে পড়ত। সুইজারল্যান্ড পাহাড়ি জায়গা, বড় মাঠের অভাব। তাই ছোট জাল ঘেরা টার্ফে খেলা হত। টার্ফের বাইরে বরফ। এবার ঐটুকু জায়গাতেই পাওলোর পায়ে ব্যানানা শটের ফুলঝুরি। পরিষ্কার দেখছি বলটা বাইরে যাচ্ছিল, কীরকম বেঁকে ঢুকে গ্যালো। ফ্লুক নয়, বারংবার। বা ধরুন, এই আপনার সামনে পাওলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পায়ে বল। চোখের পলক ফেলার আগেই পায়ে বল নেই। পাওলো খালি দাঁড়িয়ে। বল কই? আপনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কী হয়েছে, জাস্ট আপনার মাথা টপকে ফুটবল'খানা আপনার পেছনে চলে গেছে। আর পরের মুহূর্তে পাওলো আপনার পেছনে গিয়ে বলের দখল নিয়ে ভাগলবা। মানে ম্যাজিক দেখে হাঁ মুখ বন্ধ হওয়ার আগেই পাওলো হাওয়া। ১৮০ ডিগ্রি ঘোরা ছাড়া আপনি আর বিশেষ কিছু করতে পারেন নি।
সহপাঠীদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ চলার সময় পাওলোর টিম বরাবর ঐ ১০-২ বা ৮-১ এইরকম স্কোরে জিতত।তাই বলে তো আর তাকে বলা যায় না ভাই আর খেলো না। হাজার হোক, সে তো আমাদের বয়েসী একটা ছেলে। শেষ অব্দি একজন সুইস সেকেন্ড ডিভিশনের কোচ ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের টিমে খেলাবেন বলে। পাওলো দেখলো ভালোই হবে--- প্রফেশনাল লেভেল খেলা যাবে, পয়সাও পাওয়া যাবে। অড জব করতে হবে না।
পাওলো তো চলে গ্যালো। তার জায়গায় আমাদের এক সহপাঠিনী--- সেও ব্রাজিলের, খুব জেদ করল আমাকেও খেলায় নাও। বাকী মেয়েরা কেউ খেলে না ফুটবল। তাই অ্যামান্ডার খেলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু যাই হোক। ফুটবল বডি কন্ট্যাক্ট গেম। ছেলে মেয়ে একসাথে খেলবে? ধাক্কা লেগে পড়ে যাবে না? কিন্তু অ্যামান্ডার অখন্ড জেদ। আচ্ছা তাহলে তাই হোক। ফাইভ এ সাইড খেলা। ৯ টি ছেলে, ১ টি মেয়ে।
আমরা ৯ জন আলাদা করে আলোচনা করে নিলাম যে অ্যামান্ডাকে কড়া ট্যাকল, থ্রো বা পেনাল্টির পাওয়ার জন্য দেহ লক্ষ্য করে জোরে শট নেওয়া ইত্যাদি করা হবে না। সাদা বাংলায় যাকে বলে দুধে-ভাতে। আউট করা যাবে না।
এর পরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত। মাঝমাঠ থেকে তোলা বল মেয়েটি বুকে রিসিভ করল। বল বুকে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পরার আগেই পেলব শট। হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা গোলকীপার পেরিয়ে অন্য দিকের পোস্টের পাশ দিয়ে জালে গড়িয়ে গেল।

মেয়েটির নাম ছিলো অ্যামান্ডা। সে আমায় পরে বলেছিল, ফুটবল সে খুব একটা ভালো খেলতে পারে না। ম্যারাথন দৌড় বেশী প্রিয়। পাড়ায় সবাই ফুটবল খেলে জন্ম থেকে। তাই দেখে অ্যামান্ডা'ও অল্পস্বল্প শিখেছে। 

--

(২) ফুটবুলের যুদ্ধ না যুদ্ধের ফুটবল?



আজকে ইরানের খেলা দেখতে দেখতে মনে পড়ে গ্যালো নাইমেঘেন শহরে আমার চিলেকোঠার ভাড়া ঘরের কথা। বাড়ির মালিক ইতালিয়ান। আর সেখানে তিন ঘর ভাড়াটে — বুল্গেরিয়ান, ইরাকী আর ভারতীয়। ইরাকী ছেলেটির নাম ভুলে গেছি। ২০০৮ সালের কথা। তাই পুরনো সবুজ ডায়েরীটা ধুলো ঝেড়ে বার করলাম। বাকীটা সেখান থেকেই টাইপ করে লেখা। ২৩ নভেম্বর ২০০৮।
ZENO KALIED - এই হলো আমাদের বাড়ির নতুন ভাড়াটের নাম। ও আপাতত ছোট ঘরটায় উঠেছে। চিলেকোঠায় আমার ঘরটা বিশাল। সামনে মাসে আমি সুইৎজারল্যান্ডে অন্য চাকরী নিয়ে চলে যাব, তখন আমার ঘরে চলে আসবে। বাড়িওয়ালার সাথে সেরকম কথা হয়ে আছে। সাতাশ বছর বয়েস, আমার পঁচিশ। চেহারা ভারীর দিকে। মুখে একটা স্পষ্ট মধ্য-প্রাচ্যের ভাব রয়েছে। গায়ের রঙ তামাটে, অ্যাভারেজ হাইট। আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই বিদেশে অচেনা লোককে করা বাঁধাধরা এবং মরচে-ধরা প্রশ্নটা এসে পরল। “Where are you from?”
ছেলেটা বেশ গর্বিত ভাবে বলল, “আমি কুর্দিশ। নর্থ ইরাকে আমি জন্মেছি। কিন্তু আমি ইরাকী নই, নিজেকে কুর্দিশ বলতে বেশী পছন্দ করি।”
তৃতী বিশ্বের নাগরিক আমি--- প্রথম বিশ্বে এসে তক ইরাক ইরান সম্বন্ধে যা জেনেছি CNN BBC দেখেই শিখেছি। ইরাক মানেই আমার চোখে ক্যারিশ্ম্যাটিক এবং নৃশংস সাদ্দাম হোসেন। পাঠক, মনে রাখবেন ঘটনা ২০০৮ এর। সাদ্দাম কিছুদিন আগেই মারা গেছেন— আমেরিকান সৈন্যরা অতীতের প্রবল পরাক্রমশালী সাদ্দামকে গর্ত থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে মেরেছে। তো যাই হোক, আমি হাল্কা করে সাদ্দামের নামটা তুলতেই, ZENO বলে উঠল, “We are against Saddam. We fought against him.” আমি হিসেব করে দেখলাম যে ’৯১ সালে যখন ZENO ইরাক-ইরাণের যুদ্ধের সময় ইরাক ছেড়ে এসেছে তখন ওর বয়েস মোটামুটি এই দশ-এগারো। অর্থাৎ তখনই ঐ বয়েসেই ওর মধ্যে গৃহযুদ্ধের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে। ZENO আমায় বলল, দেশ ছাড়ার আগে ও অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গেরিলা যুদ্ধ দেখেছে। ওরা কাছে ১৯৫৮ সালের একটা ছবি রয়েছে যেটা ও দেশ ছেড়ে আসার সময় নিয়ে আসতে পেরেছিল। ছবিতে ওর ঠাকুর্দা— গেরিলা যোদ্ধাদের লীডার অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের সামনে দাঁড়িয়ে গার্ড অফ অনার নিচ্ছেন।
ZENO শুধু দেশ নয়, নিজের জীবন নিয়েও খুব গর্বিত। ও বলে চলে, জীবনের যে রুক্ষ কঠিন রূপ ও দেখেছে সেটা অকে মানসিকভাবে পাথর হয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সেইসাথে ZENO এটাও বলে, “আমি চাই না অন্য কেউ সেই রূপ দেখুক।” নিজে থেকে বলে যায়। দ্যাখো জয় (লেখকের ডাকনাম)— আমার কোন ডিপ্লোমা নেই। আমি তোমার মত কোনদিন ইউনিভার্সিটিতে যাই নি, যাবোও না। তোমার মতো স্মার্ট নই, গুছিয়ে কথা বলতে পারি না ইংরেজীতে। কিন্তু আমি ইতিহাসে, ভূগোলে খুব ভালো। I may be poor in mathematics. But I can pick up new languages very easily. এই তো এখন ডাচ, ইতালিয়ান, কিছুটা ফ্রেঞ্চ শিখে গেছি।”
আমি কুর্দিশদের সম্পর্কে আরো আগ্রহ প্রকাশ করলে জাত্যভিমানে ফুটতে থাকা ZENO আমায় বলে— কুর্দিশরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ইরাক, তুর্কী, মরক্কো। গর্ব ফুটে ওঠে ওর চোখে মুখে যখন ও বলে যে ক্রুসেডের যুদ্ধে বীর সুলতান সালাউদ্দীন (ZENO এর উচ্চারণে সালে-ই-দিন) ইংল্যান্ডের নাইট রিচার্ডের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন— তিনি কুর্দিশ। ক্রুসেড থেকে আলোচনা অনিবার্যভাবে গড়িয়ে যায় অধুনা আমেরিকায়। ইরাকে আমেরিকা যা করছে সে প্রসঙ্গে ZENO প্রথমে বলল, আমেরিকা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেগুলো যথারীতি কিছুই পালন করে নি। আমেরিকা নিয়ে কথা বলতে বলতে ZENO বলে তোমায় একটা প্রাচীন কুর্দিশ গল্প বলি শোনো। একটা পাখির ডানা ভেঙে গেছে। সে আর উড়তে না পেরে মাটিতে পরে গ্যালো। এমন সময় একটা গরু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আবার সেই পাখিটার ওপরে গোবর ফেলে দিয়ে চলে গ্যালো। তাতে তো পাখি আরোই নড়তে চড়তে পারে না। সে খানিক গরুকে গালাগালি করল। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে একটা বাঘ সেই পাখিতা যেটা গোবরে আটকে ছিল তাকে গোবর থেকে তুলল। জিভ দিয়ে চেটে চেটে গোবর পরিষ্কার করল। তারপর পাখিটা যখন একটু সুস্থ হয়েছে তখন বাঘটা তাকে খেয়ে নিলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি— গল্পের তাৎপর্য অনুধান করার মরিয়া প্রচেষ্টা করছি। ZENO আমার অবস্থা আন্দাজ করে বল, শোনো এ গল্পের মর্যাল হচ্ছে— যারা তোমায় সাহায্য করছে তারা সবাই তোমার বন্ধু নয়।
মানুষ তার রক্তাক্ত অতীতে ফেরত যেতে যায় না। বাংলাদেশ থেকে একবস্ত্রে যাঁরা চলে এসেছিলেন এ পারে তাঁদের অনেকেই সেই কষ্টকর শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করতে চাইন না। কিন্তু গল্প শুনতে আগ্রহী যারা, তাদের মধ্যে একটা মরীয়া ভাব থাকে। রিপোর্টারদের মধ্যে এই গুণটা তো খুব’ই জরুরী। তো আমি খিনিক ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেফেললাম, গালফ যুদ্ধের কোন স্মৃত মনে পড়ে তোমার, ZENO? দেশ থেকে পালিয়ে আসার আগের কোন ঘটন নাড়া দ্যায় এখনো? ZENO বলতে চাইছিলো না। নিজের মনেই টুকটাক কথা বলছিল— দশ বছর বয়েসে এত মৃতদেহ দেখেছে সে। চোখের সামনে চেনা মানুষ সামান্য কারণে অন্য আরেকজন চেনা মানুষের প্রাণ নিয়ে নিলো। এ প্রতিদিনের ঘটনা। এসব কষ্টের স্মৃতি এখনো ওকে তাড়া করে বেড়ায়। “আমি দেখছি এক মস্ত বড়লোক তার দামী ইউরোপীয়ান গাড়ি সহ বাক্সভর্তি সোনাদানা গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে তুলে দিচ্ছে— বিনিময় স্রেফ দুটো ঘোড়া পাওয়ার জন্যে। তুমি ভাবো— মধ্য প্রাচ্যে অর্থাৎ তেলে ভাসমান একটি ভূখন্ডে বসেও সেই লোকটি তার নিজের গাড়ির জন্য পরিশোধিত তেল যোগাড় করে উঠতে পারে নি। তাই চলাফেরার জন্যে ঘোড়াই একমাত্র ভরসা। গেরিলাদের আমেরিকা টিনে করে তেল দেয়। তাদের ঐ গাড়িটা কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
আচ্ছা, তোমরা ইরাকে ফুটবল খেলতে?
ZENO বলে চলে, “ফুটবল এমন একটা খেলা সবাই খেলে। আমরাও ছোটবেলায় খেলতাম। তবে গৃহযুদ্ধ চলছে। মানুষ পরের দিন কী খাবে ঠিক নেই। তাই প্রকৃত ফুটবল পাওয়া যেত না। কিছু একটা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে নিতাম। ছেঁড়া ন্যাকড়া এইসব আর কী!” ZENO হাসে। “গৃহযুদ্ধের সময় আমরা প্রায়ই মিলিটারি অথবা গেরিলাদের পরিত্যক্ত আস্তানায় ঢুকে পরতাম। অনেকসময় খেলার জিনিস, সিগারেটের বাক্স, মিলিটারির ফেলে যাওয়া বাসন-কোসন বা অন্য কোন জিনিসের লোভে। ওরা যখন ফাঁকা করে দিয়ে চলে যেত, সব নিয়ে যেতে পারত না। তো একবার এরকম একটা পরিত্যক্ত মিলিটারি বেসে ঢুকে পরেছি বুঝলে। কত বয়েস হবে? ঐ নয় কী দশ। আমার সাথে আমার বন্ধুরাও আছে। সবাই ফেলে যাওয়া কাগজপত্তর কাঠের আসবাবপত্র ঘাঁটছি। যদি কিছু পাওয়া যায়। আমার সামনে পরে আছে একটা ভাঙা কাঠের কাবার্ড। ভিতরে দেখলাম বেশ চ্যাপ্টা মোটা গোল গোল কীসব রাখা আছে। এই আট-দশ ইঞ্চি মত ডায়ামিটার। হাতে নিয়ে দেখলাম, ফুটবল বানানো যাবে কীনা। কিন্তু চ্যাপ্টা জিনিসে ন্যাকড়া জড়িয়ে তাকে গোল বল বানানো বহুত হ্যাপা। আর টেঁকে না। ন্যাকড়া সহজে খুলে যায়। খুব একটা কাজে দেবে না। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে ঐ কাবার্ডেই রেখে দিয়ে বন্ধুদের সাথে চলে এলাম। এর দুবছর বাদে আমি ইউরোপ চলে আসি। নেদারল্যান্ডে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে একদিন টিভি চালিয়েছে। টিভিতে গালফ যুদ্ধের ছবি দেখাচ্ছে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। দেশের ছবি বলে কথা। হঠাৎ দেখি টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে ঐ গোলগোল জিনিসগুলোর ছবি। ওগুলো গেরিলাদের বানানো ল্যান্ড মাইন।”
ZENO র শেষ কথাগুলো আমার সবুজ ডায়েরীতে লেখা রয়ে গ্যালো। “টিভিতে মাইন দেখে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল জানো। ঠিক ঐ জিনিসটাকেই— মানে সাক্ষাত মৃত্যুকে আমি ফুটবল ভেবে নাড়াচাড়া করে এসেছি। I really hope no other kid opened that cupboard ever. But I won’t know for sure. In all probability, someone did.”


Monday, February 8, 2021

দুয়ো রাজকন্যের গল্প

এটা দুয়ো রাণীর দুয়ো রাজকন্যের গল্প। বাংলা সাহিত্য মায়ের ক্রীড়া মেয়ে। 

২১শে ফেব্রুয়ারি সে তার বন্ধুনি ভাষাদিবসের হাত ধরে মন্ডপের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডের মস্তি দেখে। রাজকন্যে এখনো ভাবে একদিন তার মায়ের জন্মদিন’ও এভাবেই জাঁকজমক করে হবে। লেমন চিকেনের বদলে হয়ত কড়াইশুঁটির কচুরি হবে। 

তা হোক।

তার মার নামে এই শহর একদিন জ্বরে কাঁপত। সেদিন আর নেই। এখন শুধু বিদেশে মাকে নিয়ে গবেষণা হয়। মায়ের ছবি অবশ্য ২০% ছাড়ে কলেজ স্ট্রীটে বিক্রী হয়। কিন্তু মার কথা নাকী কেউ বুঝতে পারছে না আজকাল। 

তাই রোমান হরফে ছাপা, মার মত দেখতে কিছু পুতুল ছাপানো হয়েছে। না ইংরিজি বই নয়, রোমান হরফে ছাপা বাংলা সাহিত্য। বিখ্যাত প্রকাশনীর দামী বই Abol Tabol, by a certain Mr. Ray। 

চড়া সাজগোজ করা দুয়ো রাণীর ছবি ছাপা পাতায় পাতায় - “Kal korechhen ajob rakom Chondeedaser kurro… Uthlo kendey ‘gunga’ boley bheeshon attorabey”। 

শেষ শব্দটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল দুয়ো রাজকন্যে। বুঝতে পারে নি। বইয়ের তাক থেকে পুরনো লাল মলাটের বইটা ঝেড়ে ঝুরে বার করে, বেড়ালের ছবিটা উলটে, সন্তর্পণে বই খুলে দেখল লেখা আছে – “উঠল কেঁদে গুংগা বলে ভীষণ অট্টরবে”। সুকুমার দাদু দুয়োমেয়ের জন্মের আগেই মরে গেসল, কিন্তু কী চিরন্তন আজকেও – কালোত্তীর্ণ সাহিত্য বোধহয় একেই বলে। দুয়ো ক্রীড়া মেয়ে বাক্যটা আবার পড়ে আর নিশ্চুপে গুংগা বলে চোখের জল ফেলে।

এটুকু ভেবেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ক্রীড়া মেয়ের। পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। দুয়ো রাণীর প্রাসাদেই তার ঢোকার অনুমতি ছিল না এই সেদিন অব্দি। যেন জারজ সন্তান সে। শ্রী শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং শ্রী মতি নন্দীর প্রশ্রয়ে এই কয় দশক হলে দুয়োরাণির চাকর-বাকরেরা মেয়েকে প্রাসাদের দালানে বসে দুধ দুইতে দিয়েছে। কিন্তু দুয়ো রাণীমার চুলে চিরুণি চালানোর জন্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরদালানে ওঠার অনুমতি তার নেই।

বাড়ি ছেড়ে মনে দুঃখে চলেই গেছিল সে। কয়েকটা বাচ্চা ছোঁড়াছুঁড়ি মিলে জোর করে ভাঙা প্রাসাদের সামনে তাকে ফেরত এনেছে। তারা বলছে ক্রীড়া মেয়ের নতুন নাম দিয়েছে। তোমার নাম আর দুয়ো মেয়ে নয়। তুমি বাইশ গজের মধ্যেও আটকে নেই, তুমি বাইশ গজের বাইরে। 

সেদিন’ই অনেক দিন পরে  দুয়ো মেয়ে অবাক হয়ে শুনল কত মানুষ এখনো দুয়ো রাজকন্যের খোঁজ করে। সেই যারা ছোট্টবেলায় খেলা রাজকুমারের প্রেমে পড়েছিল, তারা। ২০১৫ তে খেলা রাজকুমার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মরে ফৌত হল। অবশ্য তার বছর দশেক আগে থেকেই খেলা রাজকুমারের শরীরটা খারাপ, কেউ খোঁজ’ও নিত না। 

সানন্দা, আনন্দলোকের মত লাস্যময়ী রাজকুমারীদের সামনে খেলা রাজকুমার ঠিক নিজেকে বিক্রী করতে পারে নি।

দুয়ো রাজকন্যে এই নতুন ছেলেগুলোর উদ্যোগে সামিল হয়েছে বটে। কিন্তু এই সেদিন হঠাৎ ঘাম দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্নে সে দেখেছিল, রোমান হরফে লেখা – “kamool, baleensTa haaraas na”। ‘বাইশ গজের বাইরে’ কি ব্যালান্স’টা ধরে রাখতে পারবে?

আমি যাকে ভালোবাসি, সে কাঁদে দুনিয়ার জন্য,

সে বড় একলা, অনন্য, বেশি বয়সের প্রেমের মত।

পৃথিবী যে নিয়মে চলছে, সে ঠিক সে নিয়মে চলে না,

তাকে সহজে বোঝা যায় না, তার ভাবনা অন্যরকম।




Friday, January 22, 2021

লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স

(১)

১৮ ডিসেম্বর ২০২০

আমি বছরে ৮-১০টা টেস্ট খেলি। তার জন্য সারা বছর নিজেকে নিংড়ে প্র্যাক্টিস করি। আমার ব্যাটের জোরে আমি ভারতীয় টেস্ট টিমে অটোমেটিক চয়েস। কোনো মা বাবা কোচ ফ্র্যাঞ্চাইজির জোরে নয়। নিজের অধ্যবসায়ের জোরে। ক্যাপ্টেন আমার স্লো ব্যাটিং পছন্দ করে না - সেটা মিডিয়ায় বলেও ফেলে। কিন্তু আমাকে বাদ'ও দিতে পারে না। কারণ আমি ব্যাট করি, আর কিছুই করি না, ব্যাট'ই করি। বিদেশে ঘন্টার পর ঘন্টা বলের পালিশ তুলে বলটাকে ভেজা সাবানের মত তুলতুলে বানিয়ে দিই। তারপর আমরা সিরিজ জিতি বা ড্র করি।


ভুল বললাম, শুধু ব্যাটিং নয়, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩০-৪০ দিনের খেলায় যখন স্লিপে আমার মাথার ওপর দিয়ে ১৪০-১৫০ কিমি/ঘন্টা বেগে বল উড়ে যায়, আমি কয়েক মিলি সেকেন্ডের সিদ্ধান্তে লাফিয়ে সেটা ধরে নিই। আমার সতীর্থরা সেই একই দিনে হাফ ডজন সহজ ক্যাচ ফেলে। বোদ্ধারা আলোচনা করেন, নতুন রঙের বল দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কীনা। হচ্ছে হয়ত, কিন্তু ৩৬৫ দিন ধরে আমি এই মুহূর্তগুলোর জন্য মনসংযোগ করি, আমার নিজের কাছে। আমার ২০-২৫ বছরের বন্ধুদের বিজ্ঞাপনে যখন সোশাল, প্রিন্ট এবং ডিজিটাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে যায়, প্রতি সপ্তাহে তাদের রোজগারের হিসেব বেরোয় ফোর্বসে, তখন আমি বাড়িতে একটা বল ঝুলিয়ে ব্যাটের সুইট স্পটে লাগানোর চেষ্টা করি। আমার সারা গালে ব্রণের ক্ষত। কোনদিন সারানোর চেষ্টা করি নি। কারণ আমার ব্যাটের ব্লেড মাখনের মত পরিষ্কার। সেখানে লেগে বল বাধ্য বাচ্চার মত আমি যেখানে যেতে বলি চলে যায়।


আমি পূজারা, আমার খেলা প্রাণভরে দেখে নিন। কারণ আমিই দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স, দ্য লাস্ট ওয়াল স্ট্যান্ডিং। ভারতীয় ক্রিকেট থেকে ওই পদটা উঠে যাচ্ছে।


নাকি দাবিদার আছে আর কেউ? জানেন নাকি?

(২)

১১ জানুয়ারি ২০২০

অসফলদের এই পৃথিবীতে কোন জায়গা নেই। সেটা আমি জানি, কিন্তু আমার থেকেও ভালো জানে অন্যদিকের বাইশ বছরের ছেলেটা। ঋষভ পন্থ। ভালো কিপিং করতে পারছে না। কিন্তু মার খেয়ে মার দিতে জানে।
আরো অনেক কিছু জানে। টেস্টের পঞ্চম দিনে লাঞ্চের দু ওভার আগে হঠাৎ আমার একটা কুইক সিঙ্গেল নিতে ইচ্ছে হল। খুব শান্তভাবে আমায় না বলল। দেখে কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই ব্যাক টু ব্যাক ছয় মেরেছে। কই রান আউট নিয়ে বাকি মহারথীরা আমার ওপরে যা রাগ প্রকাশ করেন, ও তো সেরকম কিছু করল না।

আর কি জানে জানেন? আমাকে সম্মান দিয়ে নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে। ঋষভ জানে, আমরা যারা সেকেন্ড ফিডল খেলি, আমরা অনেক কিছুই পারি না। আমরা স্লো খেলি, সেফ খেলি। সেটা মানিয়ে নিয়ে ভারতীয় জাতীয় টিমের অন্য তারকা ব্যাটসম্যানেরা কেন পারবে না নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলতে? ঋষভ তো নতুন ছেলে হয়েও দিব্যি পারছে।

আজকে আমি বিশ্রী খেলছি, কিন্তু বিশ্রী ভাবে এখন অব্দি ১৫০ বল খেলে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করবেন, আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলনেও আমি বলেছি, আবার বলছি এর চেয়ে ভালো কিছু আমি পারি না।

প্রোটাগনিস্ট প্রচারের পুরো আলোটাই শুষে নেয়, আমরা কেবল ভরসা দিই। আমরা খেলি সচিনের আলোয়। লক্ষ্মণের আলোয়। ফলোঅনের পরে ৬২ স্ট্রাইক রেটের জ্বলজ্বলে ২৮১ এর পাশে ৫০ স্ট্রাইক রেটে ১৮০ ম্রিয়মাণ হয়ে ঝুলে থাকে। সৌরভ যখন টনটনে ১৮৩ হাঁকান, আমরাই থাকি ক্রিজের অপর প্রান্তে ১৪৫ এর ভরসা নিয়ে।

কিন্তু আমরা এটা পারি। বারবার পারি। আমরা এটা পারতে ভালোবাসি। এটা পারলে আমরা গর্বিত হই।
আমরা এরকমই।

আমাদের এককালের সতীর্থ এবং ক্যাপ্টেন, বর্তমানে আইসিসির মাথা, নিজের আইডি কার্ড বা মাস্ক ছাড়া গটগট করে এয়ারপোর্টে ঢুকে পরেন, পাইলটদের জন্য রিসার্ভড গেট দিয়ে সরাসরি প্লেনে উঠে যান। তখন প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে, ছেলের হাত ধরে, আপনাদের মাঝে, চিড়িয়াখানায় ঢোকার লাইনে আমরাই দাঁড়িয়ে থাকি। আমরাই পারি পড়াশোনা না করে পাওয়া পি এইচ ডি ডিগ্রি ফেরত দিয়ে দিতে। আমাদের রিটায়ারমেন্ট ম্যাচে আমরা বড় বক্তৃতা দিই না, কারণ আমাদের প্রস্তুতি তখনো ক্রিকেটেই, নিজেকে নিয়ে নয়। স্যার ডনের ওরেশনে বক্তৃতা দিতে যখন আমাদের ডাকা হয়, তখন আমরা প্রস্তুতি নিয়ে ধীর শান্ত ভাবে কথা বলি।

আমাদের নাম দ্রাবিড়, আমাদের নাম পূজারা।

(৩)

১৯ জানুয়ারি ২০২১

বয়েস বাড়ার সাথে সাথে বারবার নতুন প্রেমে পড়ে যাওয়া একটা রোগ। ভালো রোগ। কুড়ির সচিনকে দেখে যে ভেবেছিল প্রথম প্রেম টিকে যাবে, কবজির আজহারের দিকে সেই লুকিয়ে তাকিয়েছিল। তারপর ন্যাটওয়েস্টে জামা খুলতে দেখে একগাদা তাবিজ থাকা সত্ত্বেও সে চোখ ফেরাতে পারে নি। সুইং পিচে ভারতীয় দেওয়ালের গায়ে দমাস করে ধাক্কা খেয়েছিল। তারপর ঘোড়ার মত চুলের এক উইকেটকীপার যখন তরুণদের নিয়ে বিশের ক্রিকেটের বিষক্ষয় করে ফেলল আর ক্যান্সার নিয়ে রক্ত ওগলাতে ওগলাতে পঞ্চাশের বিশ্বজয়। ওহো পাগড়ি পড়া একটা রোগা ছেলে যে ভারতীয় অধিনায়কের চোখে না পড়লে কানাডায় ট্রাক ড্রাইভার হয়ে যেত, তার দিকেও দুষ্টুমিভরা হাসি দিয়েছিল। তারপর এল বিরাট ঔদ্ধত্যের প্রেম, চেজ করে ১৮৩ রান করে বুক চিতিয়ে জেতার প্রেম।


সেই প্রায়-চল্লিশ আজকে আবার প্রেমে পড়েছে। আঘাত চিহ্নের। ভিক্টর ট্রাম্পারের নাকি এরকম হত। স্টিকি পিচে একজন সমর্থকের উপহার দেওয়া নতুন ভারী ব্যাট নিয়ে টেস্টে ৭০ এর আশেপাশে রান করেছিলেন। সমর্থকটির একটি ক্রিকেট সরঞ্জামের দোকান ছিল, যদি ট্রাম্পার ভালো খেলেন তাহলে তার ছোট্ট দোকানের বিক্রি-বাটা বাড়বে। ট্রাম্পার ড্রেসিংরুমে ফেরত আসার পরে সাদা জামাটা খুলতেই বুক পিঠময় শুধু বলের সেলাইয়ের নির্মম লাল ছাপ।


গাব্বায় পূজারা জামা খুলবেন না। ওঁরা এরকম করেন না, অনন্ত লড়াই করেও করতে পারেন না। আজকে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ধীরতম হাফ-সেঞ্চুরি করেলেন। কিন্তু সেটা উনি জানেনও না, যেটা জানেন...


ক্রীড়াসাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য একবার আমায়
রাহুল দ্রাবিড়ের গল্প বলেছিলেন। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের ট্রফি, চেক, ম্যান অফ দ্য সিরিজের গাড়ি, পোডিয়ামে উজ্জ্বল আলোয় হাততালির মধ্যে প্রাইজ - এসব উজ্জ্বল মুহূর্ত দ্রাবিড়কে টানে না। শুধুমাত্র একটা দৃশ্যকল্পের জন্য তিনি ব্যাট করেন। বল ব্যাটের মাঝখানে লেগে সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। ওই যে দড়িটা পেরোলো, গড়িয়ে গড়িয়ে, ওই শুভক্ষণের জন্যেই এত ঘাম, এত রক্ত।


আজ, পূজারা, আমার নবতম প্রেম যেন সেই অর্গাজমের স্বাদ পান। উইনিং শট। তারপর না হয় জামার নিচে, হেলমেটের নিচে সেলাইয়ের দাগের হিসেব করা যাবে। "Wait until you get to Gabba, mate" - টিম পেনের অমর উক্তি। এটারও হিসেব হবে।

https://www.espncricinfo.com/video/watch-ten-blows-pujara-copped-on-his-body-on-the-final-day-aus-vs-ind-2020-21-4th-test-5th-day-1248450



Sunday, March 31, 2019

অলাদা, লঙ্কাদা এবং রামপ্রসাদ

জানুয়ারি মাস, ১৯৯২। মফস্বলের রাস্তা, বি টি রোড থেকে ঢুকে গেছে, গঙ্গার দিকে। রাস্তার ওপরে হাসপাতাল, ডাকঘর। ঢাকা নর্দমার ওপরে একটা পরিচ্ছন্ন দোকান। চুল কাটার দোকান। রামপ্রসাদ কাকু চুল কাটছে। শৌখিন টিপটপ সাদা জামা, ব্যাকব্রাশ করা জেট ব্ল্যাক চুল। পাতলা গোঁফের কোণ দুটো বেশ তরিবৎ করে পাকিয়ে পাকিয়ে বেঁকানো হয়েছে। রোগা শত্রুঘ্ন সিনহার মত দেখতে।

একটা বিশাল কাঠের চেয়ারে আমি বসে আছি। স্মৃতি বিশালত্ব আরোপ করেছে ঠিকই, কিন্তু আবার ভেবে দেখলাম সত্যিই চেয়ারটা বিশাল। কাঠের চেয়ারের হ্যান্ডেল দুটোর ওপরে মাঝামাঝি জায়গায় একটা কাঠের তক্তা পাতা আছে, বাচ্চাদের জন্য - সেখানে আসীন আট বছরের আমি। রামপ্রসাদ কাকুর একটা কালো রেডিও, চকচকে, রোদ পেছলায়। তাতে ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া টেস্টের কমেন্ট্রী হচ্ছে। আশেপাশের দোকানের সবাই, পথচলতি মানুষ সব্বাই শুনছে। হাত চলছে, গল্প হচ্ছে আর ক্রিকেট শোনা হচ্ছে। আমাদের ভোরবেলা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় খেলা শুরু হয়েছে। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে আমি আমার সীমিত হিন্দিজ্ঞান উপচে নিয়ে খেলার হালহকিকত বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বাবা বাজারে যাওয়ার আগে রামপ্রসাদ কাকুর কাছে জিম্মা করে দিয়ে গেছে। খুব পরিষ্কার নির্দেশ, চুল কাটার পরে যেন দু আঙ্গুল দিয়ে চুল টেনে ধরা না যায়, তাহলেই রামপ্রসাদ কাকু ফেল। 
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হিন্দি এবং বাংলা সিনেমার হিরোরা ঢেউ খেলা লম্বা চুল রাখতেন। মানে তাঁদের মধ্যে একটা নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদ ছিল। তাই হিরোইন ঘপাঘপ চুল কেটে ফেলতেন, বোধহয় ববকাট বলত। আর পুরুষ অভিনেতারা ঘোড়া-মার্কা ঢেউ ঢেউ চুল রাখতেন। তবে ঘোড়ার মত জোরে দৌড়তে পারতেন না বলে স্ট্যান্ড ফ্যান দিয়ে তাঁদের চুল ও অভিনেত্রীর স্কার্ট ওড়াতে হত। এর একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব মফস্বলের স্কুলেও আছড়ে পড়েছিল। রামকৃষ্ণ মিশনে আমাদের চুল কাটার ব্যাপারে কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। ছাত্রের বাড়িতে রিপোর্ট যেত, তাতে কাজ না হলে গার্ডিয়ান কল হত। 
আঃ দেখেছেন গার্ডিয়ান বলে ফেললুম, আজকে আমরা শুধু নব্বইয়ের মফস্বলী ভাষায় কথা বলব। শুধু গার্জিয়ান কল নিয়ে এক পাতা লিখে ফেলা যায়। আজকে শুধু বলে রাখা যাক, শান্ত মফস্বলের স্কুল জীবনে গার্জিয়ান কল এক আতঙ্কের অধ্যায়।

বাবা বাজার থেকে ফিরলে আমায় নিয়ে ডক্টরস কোয়ার্টারে যাবে, তারপর আমি স্কুল। বাবা যাবে হাসপাতাল। ভাই মার সাথে বাড়িতে। স্কুল থেকে ফিরলে আমি আবার মার সাথে হাসপাতালে। স্কুলে নতুন ক্লাসে উঠলে, প্রথম দিন রোল কলের সময় মাষ্টারমশাই জিজ্ঞেস করেন, কে কোথা থেকে এসেছে? তোমার বাড়ি কোথায়? আমি উত্তর দিতাম - বলরাম সেবাকেন্দ্র হাসপাতাল। সারা ক্লাস হাসিতে ভেঙ্গে পড়ত, হাসপাতালে কেউ থাকে নাকি রে বোকা? জ্বর-জারি হলে যায়। কিন্তু আমি তো ছোট। বাবা মা তো কোয়ার্টারে রেখে যেতে পারেন না, সাথে নিয়ে নিয়ে ইভনিং ডিউটি, মর্নিং বা নাইট শিফট করেন।

ওদিকে রেডিওতে শোরগোল শুরু হয়েছে। রবি শাস্ত্রী বলে কেউ একটা ডাবল সেঞ্চুরি করেছে। ডাবল সেঞ্চুরি শব্দবন্ধের অর্থ তদ্দিনে জানা হয়ে গেছে। ১৯৯২ ওয়ার্ল্ড কাপ সামনে। নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেটেড রাখতে হচ্ছে বৈকি। রাম প্রসাদ কাকুর পরের দোকানটাই লঙ্কাদার। লঙ্কাদার বয়েস রামপ্রসাদ কাকুর থেকে বেশী হতে পারে, অন্তত তাই দেখায়। কিন্তু কোন অজানা কারণে উনি সবার দাদা। আমার দাদা, আমার বাবার দাদা, আমার ভাই যখন কথা বলতে শিখবে তারও দাদা হবেন। অদ্ভুত ব্যাপার। কাউকে কোনদিন বলতে শুনি নি লঙ্কাকাকু বা লঙ্কা জেঠু বা শুধু লঙ্কা। ফর্সা ছয় ফুটিয়া রোগা চেহারা। কবজি দড়ি পাকানো। দুহাতে নীল শিরা ফুলে আছে, ফরসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপরে। ভারী ফ্রেমের চশমা আর ঝাঁটা ঝাঁটা গোঁফ। হাতের তালু দুটো নোংরা, বিচ্ছিরি রকম নোংরা।
সারা দিন ধরে সাইকেল ঘাঁটছে তো।

ওই তো একটা সাইকেল লিক এসেছে। আমি কাঠের চেয়ারের আসন থেকে শ্যেন দৃষ্টিতে লক্ষ রাখছি। আমার বর্তমান সাইকেল নাকি দু চাকার, আমি সবাইকে তাই বলি। আসলে বাঁপাশে একটা তিন নম্বর চাকা হেলান দিয়ে লাগানো। মানে ওই দিকে সাইকেল হেলে গেলে মাটিতে পা না পেলেও সাইকেল থেকে পড়ব না।
ধুস্‌, কবে যে লম্বা হব?

দু চাকার সাইকেল চালানো একটা অন্য স্কিল, কবে যে পারব? তিনটে চাকা লাগানো সাইকেল - লোকজনকে বলতে প্রেস্টিজে লাগে। ক্লাস টু, দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রেস্টিজ, বড়ই মুচমুচে।
নাঃ, আরও অ-নে -ক লম্বা হতে হবে। আঠাশ ইঞ্চির ডার্ক গ্রিন হারকিউলিস সাইকেল চালাতে না পারলে জীবন বৃথা। ঘন সবুজ রঙের রাজহাঁস। রাস্তায় একটা পা বিটি রোডে। পিচের ওপরে থাকবে, আর একটা পা সাইকেলের প্যাডেলে। পিচের ওপরে কেউ যেন বুঝতে না পারে যে মাটিতে পা ঠেকাতে কি কষ্ট হচ্ছে। ব্যালে ড্যান্সারের স্কিলে গোড়ালি থেকে পায়ের পাতা নব্বই ডিগ্রীতে বেঁকিয়ে মাটিতে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।

ওখানেই শেষ নয়, তারপর ডাবল ক্যারি করা শিখতে হবে। শেষ স্টেপ হাত ছেড়ে চালানো - দু হাত ছেড়ে। আর এইসব সব স্কিল যারা সহজেই দেখাতে পারে, তারা এসে লঙ্কাদাকে কাকুতি মিনতি করে - আমার সাইকেল টা একটু দেখে দাও না লঙ্কাদা। 
স্পিড উঠছে না, পাশের পাড়ার একটা ছেলে কি একটা রং বেরঙের সাইকেল কিনেছে। সেদিন রেসে হেরে গেলাম।
লঙ্কাদা গজ গজ করছে, শোন হারিকিউলিসকে কেউ হারাতে পারে না। তুই চালাতে পারিস না, তাই হেরে গেছিস। কোথায় রেস হচ্ছিল?
ঘোষপাড়ার মাঠ চক্কর দিয়ে। বড় রাস্তায় রেস করতে বারণ করেছে তাই।
হুম, ছেলেটা নিশ্চয়ই তোকে মাঠের কোণা দিয়ে মোড় ঘোড়ার সময় বিট করেছে? হ্যাঁ, জানলে কি করে?
জানলাম আর কি করে। তোর বাবারও এই এক প্রবলেম ছিল। শোন মোড় যখন ঘুরবি, বেড়টা একটু বড় করে নিবি। এক দু মিটার বেশী যেতে হবে, কিন্তু স্পীড নামাতে হবে না।

রামপ্রসাদ কাকুর কাঁচির ঝনঝনানি ছাপিয়ে আমার কানে শুধু এই বুদ্ধি ঢুকছে। উফ্‌ একবার সাইকেল চালাতে শিখি। তারপর লঙ্কাদাকে তাক লাগিয়ে দেব। 
আর একজন এসেছে। সাইকেল লিক। এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। হাসপাতালে জ্বর পেটখারাপ সর্দি কাশির মত। লঙ্কাদা সাইকেলের টায়ার খুলে তার ভেতর থেকে টিউবটা বার করল। তারপর হাওয়া ভরে জলে ধরে ধরে লিক খুঁজে বার করল। তারও পরে একটা কালো চওড়া ফিতে থেকে চৌকো একটা অংশ কেটে নিয়ে সেটা কে ভালো করে জলে ঢুয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করল। একটুও ধুলো যেন লেগে না থাকে, তাহলে আঠা ধরবে না। এরপরে স্টেপটা শৈল্পিক - ওই চৌকোখণ্ডটার প্রতিটি কোণা কেটে কেটে গোল করা হল। আজকের আমি জানি ওটাকে বলে রাউন্ডেড রেক্ট্যাঙ্গল - কেন করা হল? আঠা দিয়ে লাগানোর পরে  কোণা কোণা হয়ে থাকলে সাইকেল চালানোর সময় সহজেই কোণাগুলো ঘষা খেয়ে উঠে আসতে পারে। সেটাকে আটকানো হল।

লঙ্কাদা আর রামপ্রসাদ কাকুর উল্টোদিকে রাস্তা পেরিয়ে অলাদার দোকান। হাসপাতালে গা ঘেঁষে পাকা দোতলা বাড়ি - দেখলেই বোঝা যায় শক্তপোক্ত বাড়ি। মধ্যবিত্ত বাহারি বাড়ি নয়। একতলায় দোকান, দোতলায় ঘর। সিমেন্টের দোকান। ছোটবেলায় আমার খুব ইচ্ছে ছিল জিজ্ঞেস করার উনি কোন দোকানের সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন? বাড়ি বানানোর আগে তো ওঁর কাছে দোকান ছিল না,  সিমেন্ট'ও ছিল না, তাই না? 
অলাদা রাশভারী পয়সাওলা মানুষ। সকালে রামপ্রসাদ আর লঙ্কাদার দোকানের দিকে মুখ করে খবরের কাগজ পড়ছেন। মুখ দেখা যাচ্ছে না। দেখা গেলে কন্ট্রাস্ট শব্দের সংজ্ঞা জানা যেত। ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর নিকষ কালো মুখমণ্ডল। প্রথম প্রজন্ম ধনী হয়েছে সেটা বোঝা যেত। সকালে লুঙ্গি পরে অলাদা নিজের সিমেন্টের দোকান নিজেই ঝাঁট দিয়ে সাফ করতেন। পরের প্রজন্মকে বিশেষ হাত লাগাতে দেখা যেত না।

...

আজকে এই অব্দি থাক। 

ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে গেছে আজ বারো বছর হয়ে গেল। রামপ্রসাদ কাকু বিষয়ী মানুষ - তাই ফ্ল্যাট বাড়ির পেছনের দিকে একটা দোকান বাগাতে পারেছে। কিন্তু লোকে আজকাল শুধু কাঁচির কারিকুরিতে আকৃষ্ট হচ্ছে না, রেডিও তে টেস্ট নয়, মোবাইলে আই পি এল টাই এখন চল। রামপ্রসাদ কাকু হাঁটছে, জোরে দৌড়চ্ছে এই সময়টাকে ধরবার জন্য।

অলাদা সিমেন্টের দোকানে ঝাঁট দিয়ে জড়ো করা প্লাস্টিকে আগুন জ্বালাতে গিয়ে লুঙ্গিতে আগুণ ধরিয়ে ফেলেন। বলরাম সেবা মন্দিরে যখন নিয়ে যাওয়া হয়। কুচকুচে কালো মানুষ তো, তাই দেখে বোঝা যাচ্ছিল না, হাসপাতালে টের পাওয়া গেল ৭০% বার্ন হয়ে গেছে। ডিউটীতে মা, বড় হাসপাতালে রেফার করা হয়, কিন্তু বাঁচানো যায় নি। অলাদার ছেলে সিমেন্টের দোকানের জায়গায় ওষুধের দোকান দিয়েছে, হাসপাতালের পাশে চলবে ভাল।

লঙ্কাদা তাঁর দোকানের পরিবর্তে কিছু জোগাড় করে উঠতে পারেন নি। অবিবাহিত মানুষ, ভাইপোরা এক বেলা ভাত ডাল খেতে দিত। আর লঙ্কাদা শেষের দিকটা বাড়ি বসেই সাইকেল সারাত। লঙ্কাদা সময়কে ধরার চেষ্টা করে নি। গিয়ার ওলা সাইকেল দেখলে না করে দিত। হারকিউলিস হচ্ছে রাজা সাইকেল। সেসব ছেড়ে এই রং বেরঙের খেলায় লঙ্কাদা নামতে পারেনি। শেষের দিকে প্রায় অভুক্ত অবস্থায় মৃত্যু।

আমার সময় আরও দ্রুত ফুরিয়ে আসার আগে, রামপ্রসাদ কাকুর দোকানে ওই দু আঙ্গুলে ধরা যায় না, সেই রকম করে চুলটা কেটে আসতে হবে। 

সময়টাই বা আঙ্গুলে ধরতে পারছি কই? 

Sunday, February 17, 2019

না-মুমকিন (২)

(দু'একজন জিজ্ঞেস করেছেন আমি কোন বই থেকে ঝেড়ে লিখছি। সেটা আপাতত উহ্য থাক। গুরু তারাপদ রায় শিখিয়েছেন, মন্ত্রগুপ্তি কাউকে শেখাতে নেই। এখন আপাতত শুধু সেই বইয়ের উৎসর্গ বলে দেওয়া যাক। লেখকের সাত বছরের ছেলে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখে বাবাকে বলেছিল, বাবা আমি আর চার বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট খেলতে চাই। বাচ্চা ছেলে আবেগ চেপে রাখতে পারে নি। বাবার জবাব ছিল, উচ্চাকাঙ্খা যদি করতেই হয়, সেটা সুউচ্চ হওয়াই কাঙ্খিত। মনে রেখ, ডব্লিউ জি গ্রেস নয় বছর বয়েসে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক করেছিলেন।)

অবশেষে মাইক সিমন্স কোম্পানির চাকরিটা হয়ে গেল। আপাতত খাওয়াদাওয়ার চিন্তা নেই। টেস্ট শেষ হলে বাড়ি ফিরে যাবার ট্রেনের ভাড়া তো বোর্ড দেবে। বলা যায় না, অ্যাসেজের শেষে হাতে কিছু জমতেও পারে। একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। এই কদিন আগে অব্দি সে টেস্ট খেলার যোগ্য কিনা তাই নিয়ে ক্রিকেটপ্রবর সাংবাদিকেরা নাক সিঁটকাচ্ছিলেন। নট ব্যাড।

কি চরম নাটকীয় মোচড়ে বিধাতা এই ছেলের প্রথম টেস্ট সিরিজের সুর বেঁধে দিয়েছেন।

সিরিজের শুরুতেই তো নিউ সাউথ ওয়েলসের সাথে এমসিসির ম্যাচ। ব্র্যাডম্যান অটোমেটিক চয়েস। তো ছোকরা খারাপ করল না। ওদিকে হ্যামন্ড যে ভালো খেলবে জানাই ছিল, দু ইনিংসে ২২৫। ব্র্যাডম্যান একটু বেশী - ২২৯, গড়ও ওই ২২৯। এই গড় বা অ্যাভারেজ জিনিসটা নিয়ে ব্যাটাচ্ছেলে যেন ছেলেখেলা করছে। সংজ্ঞাই পালটে দেবে মনে হচ্ছে। সেদিন নির্বাচক কমিটির মিটিং এ কথা হচ্ছিল, এত কম বয়েসে দেশের হয়ে খেলবে, এর স্কুল ক্রিকেটের গড়টা একবার দেখে নেওয়া দরকার। পাওয়া গেল না, মানে ক্যালকুলেট করা গেল না। হতচ্ছাড়াকে স্কুল ক্রিকেটে কেউ আউট করতে পারে নি। গড় অসীম।

নির্বাচকরা ঠিক করলেন, ১৬ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া একাদশ এমসিসি ম্যাচে ব্র্যাডম্যানকে খেলানো হোক – ৩০ নভেম্বর প্রথম টেস্ট শুরু, তার আগে ছোকরাকে একবার ভালো করে দেখে নেওয়ার এই শেষ সুযোগ। এমনিতেই ক্রস ব্যাটে খেলে, লারউডকে কি সে আরেকবার সামলাতে পারবে? অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যতই গণ্ডা গণ্ডা রান করে থাকুক, বিদেশী অচেনা ফাস্ট বোলার নিয়ম করে সামলাতে আলাদা বুকের খাঁচা দরকার। ছেলেটা মোট ৭৬ করল, ম্যাচের গড় ৭৬, সিরিজের গড় ১৫০ প্লাস।
ফলত প্রথম টেস্টে সিলেকশন এবং সে টেস্টে দু'ইনিংসে গড় ৯। এটা নির্বাচকদের সত্যিই বড় ধাক্কা দিল। আপনিই ভাবুন না, ধরুন ভালো ইলিশের দাম আপনি জানেন হাজার টাকা প্রতি কিলোর নিচে হয় না। হঠাৎ বাজারে গিয়ে দেখলেন পঁয়ষট্টি টাকা কিলো দু কেজির ইলিশ, আপনার চোখে সন্দেহের বাষ্প ঘনিয়ে আসবে না? ব্র্যাডম্যান, যে ছেলে কোনোদিন একশোর নিচে নম্বর পায় না, বড়োজোর নব্বই, সে যেন জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় ব্যাক পেল।

সেকেন্ড টেস্ট ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে গুচ্ছ নাটক। দেশ চাইছে তরুণ ব্র্যাডম্যানকে। এতোটাই চাপ যে নির্বাচক কমিটির প্রধানকে নতুন করে বিজোড় সংখ্যার নির্বাচক কমিটি বানাতে হয়েছে। ছেলেটা তো প্রথম টেস্ট বাদ দিলে বড্ড ভালো খেলছে।
এমনিতেই এবারের ইংল্যান্ড টিম খুব ধারালো। হ্যামন্ড নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যাটিংকে - পঁচিশ বছর বয়েস। ব্যাটের হাত চমৎকার। আর বোলিং করছে বটে লারউড – সেও পঁচিশ। দু টিম মিলিয়ে দ্রুততম বোলার। দুজনেই কেরিয়ারের শীর্ষে।
তাদেরকে সামলানোর জন্য বুড়োদের ওপর ভরসা রেখে তরুণ ব্র্যাডম্যানকে বলি দিলেন নির্বাচকেরা।

সেকেন্ড টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে বিশেষ সুবিধে করতে পারে নি। ইংল্যান্ড বরং নেমে বিপক্ষ বোলারদের বেশ খাটান দিয়েছে। এগারোটার মধ্যে দশটা ব্যাটসম্যানই দু ডিজিটে রান করেছে। আর এক জন, হ্যামন্ড অবশ্য তিন ডিজিটে - ৬০৫ বল খেলে ২৫১ রান। তার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সেকেন্ড ইনিংসে দুটো সেঞ্চুরি থাকা সত্ত্বেও ফোর্থ ইনিংসে বারো রানের বেশী টার্গেট রাখা যায় নি। ফলশ্রুতি গোহারা হার। এবং পুনর্মুষিক ভব। থার্ড টেস্টে ব্র্যাডম্যান ফেরত।

থার্ড টেস্টে বেশ মজার ব্যাপার হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া ৩৪৭ রানে আট উইকেট, এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। হতচ্ছাড়া ফেন্ডার পরের দিন লিখেছিল, সারা রাত ধরে এমন বৃষ্টি পড়েছে, মনে হচ্ছিল যেন হোটেলের ছাদে বসে কেউ ইংল্যান্ডের কফিনে পেরেক ঠুকছে।
পরের দিন রাইডার ডিক্লেয়ার না করে খেলা চালিয়ে গেলেন। বৃটিশ ক্যাপ্টেন চ্যাপম্যান স্পেশালিষ্ট বোলারদের হাতে বল তুলে দিলেন। চার রান যোগ করে ৩৫১ তেই অস্ট্রেলিয়ার নটে গাছটি মুড়িয়ে গেল। 
দুই অধিনায়কেরই আসলে স্ট্র্যাটেজি ভুল হয়েছিল। ওই আঢাকা কাদামাখা উইকেটে শেষ দুই ব্যাটসম্যানকে খেলানোর জাস্ট কোন মানে হয় না। কটা রান আর হবে। তার চেয়ে ডিক্লেয়ার করে বিপক্ষের টপ অর্ডারকে ধসিয়ে দেওয়া অনেক বেশী কাজের। আর কেউ যদি একান্ত খেলিয়ে যায়ই, তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের আউট করারও কোন মানে হয় না। শেষ দুই ব্যাটসম্যান খেলছে খেলুক না। উইকেটটা তো শুকাবে।

কাদামাখা শুনে যদি অতিশয়োক্তি মনে হয় - তাহলে শুনুন পরের দিন খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই দিন প্রথম চার ঘণ্টায় বেশীরভাগ বল পিচে পড়ার পরে থেমে গেছিল। ইট ওয়াজ জাস্ট গেটিং স্টাক – হেন্স দ্য ফ্রেজ স্টিকি উইকেট। কথার কথা নয়, বলটা পিচে জাস্ট আঠার মত আটকে যাচ্ছিল।

Friday, February 15, 2019

না-মুমকিন (১)

ডিপ্রেশন দেশটাকে ছিঁড়ে ফেলছে। লোকে রেশনের দোকানে লাইন দিয়ে ফুড কুপন তুলছে। দলে দলে মানুষ রাস্তায় হাঁটছে, বিক্ষোভ সবে দানা বাঁধছে। গ্রেট ডিপ্রেশনের শুরু। তারই মধ্যে মিছিল থেকে চোখ সরিয়ে একটা বছর কুড়ির ছেলে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে সিগাল পাখি দেখছে। ভ্রু-কুঞ্চিত।

থার্ড টেস্টে ৯৬ রানে নট আউট। মেলবোর্ন মাঠটা বেশ বড়। বলটা ঠেলেই বুঝতে পেরেছিল যে বাউন্ডারি নাও হতে পারে। দে দৌড়। চারটে রান দৌড়ে নিয়ে ব্যাট তুলেছিল। সে সুখস্মৃতি স্থায়ী হয় নি। ম্যাচ আর সিরিজ দুটোই তো হেরে গেল অস্ট্রেলিয়া। বেমক্কা নয়, হারার'ই ছিল। বুড়ো প্লেয়ারদের বাতি নিভে এসেছে। হেনরি, কিপ্যাক্স, কেলওয়ে, রাইডার, ব্লেকি - সব চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে। নড়তে চড়তেই সময় চলে যাচ্ছে। বোলারদের বলে না আছে কামড়, আর ব্যাটিং আর ফিল্ডিঙে দৌড়ের নমুনা নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। তাই এবারে নির্বাচকেরা জ্যাক্সন আর ব্রাডম্যান বলে দুজনকে টিমে নিয়েছেন, কুড়ি আর উনিশ। মানে এদের মিলিত বয়েস ওই আগের লিস্টের প্রত্যেকের থেকে কম।

এক হ্যাঁচকা টানে বর্তমানে ফিরে এল ছেলেটা। আজকে ৫ই মার্চ, ১৯২৯। তিনদিন বাদে ফাইনাল টেস্ট শুরু। ফিফথ টেস্ট অব অ্যাসেজ। আবার মেলবোর্নেই পড়েছে। ছেলেটা মোটামুটি নিশ্চিত টিমে থাকছে। কিন্তু তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। যে ভাবেই হোক, একটা চাকরি জোটাতে হবে। টেস্ট ক্রিকেট খেলে তো ভাই পেট চলবে না। বাউরালে জেসি অপেক্ষা করছে। ইচ্ছে ছিল, কুড়িতে পা দেওয়ার আগেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলবে। কিন্তু পাকাপাকি একটা রোজগারের ব্যবস্থা না হলে তো সেসব প্রগলভতা মাত্র।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠল সে। মাইক সিমন্স কোম্পানির ম্যানেজার অস্কার লসন স্কুলবয়দের কোচিং করার একটা চাকরি জোগাড় করে দেবেন বলেছেন। তাতে কোম্পানির নাকি পি আর হবে। দেখা যাক।

মনটা সামান্য বিক্ষিপ্ত। অনেক কষ্টে যদিও বা টেস্টের দরজা খুলল, প্রথম সিরিজেই ফোর-নিল পিছিয়ে, কোনো মানে হয়? সারা দেশ হা পিত্যেশ করে তাকিয়ে আছে এই খেলাটার দিকে। খেলা তো নয়, আসলে এককালের মনিবের হাত থেকে ট্রফি ছিনিয়ে নেওয়া। সত্যি, থাকিস তো ওই পুঁচকে একটা দেশে। শুধু ব্রিটেন বললেই চলে যেত। তা নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে গ্রেট ব্রিটেন আর তার কলোনি। সব দেশ থেকে তাদের ধনসম্পত্তি লুঠ করেই বাছাধনেরা দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছিল, এখনও যাচ্ছে। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়া স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিল। শোনা যাচ্ছে এখন নাকি ব্যাটাদের সব মৌজ-মস্তি ভারতবর্ষ বলে একটা দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে হয়।
এবারের ভিজিটিং ইংলিশ টিমের সাথে পার্সি ফেন্ডার বলে একটা ব্রিটিশ এসেছে - হাড় জ্বালানে লোক একটা। আগে ক্রিকেট খেলত – হাসির খোরাক - ব্যাটিং অ্যাভারেজ কুড়ির নিচে, বোলিং চল্লিশের ওপরে। যাজ্ঞে, নির্বাচকরা এবার আর খেলাতে সাহস করে নি। তাও এত সখ, স্রেফ ক্রিকেট নিয়ে লিখবে বলে অস্ট্রেলিয়া চলে এসেছে। কিন্তু স্বভাব কি আর হাত থেকে ব্যাট নামিয়ে রাখলে চলে যায়। ওর নাকি ট্রেনে টুথপেস্ট ফুরিয়ে গেছিল, তো সহযাত্রীকে ভজিয়ে, ব্রিসবেন থেকে তিনহাজার কিলোমিটার দূরের একটা ছোট গ্রামের স্টেশনে সহযাত্রীকে নামিয়ে তার সাথে পাক্কা কুড়ি মিনিট বাবু হেঁটেছেন। তো সে হেঁটেছেন তো বেশ করেছেন, এ তো আর লন্ডন নয় রে বাবা যে মোড়ে মোড়ে  টুথপেস্টের দোকান থাকবে। গ্রামের সেই দোকান পাওয়াও গেছিল, কিন্তু দরজা জানলা সব বন্ধ। দুপুর হতে চলল কিন্তু দোকান খোলে নি, তাই একটু রেগে দরজা ধাক্কাতে গিয়ে ছোট্ট চিরকুটটা চোখে পড়ল। "Closed. Gone to the Test” - দোকান বন্ধ থাকিবে, খেলা দেখিতে যাইতাছি। ফেন্ডার তো রেগে কাঁই – দোকানিটা পাগল ছাগল নাকি? তিনহাজার কিলোমিটার দূরে ক্রিকেট দেখতে গেছে।

ফেন্ডারকে বোঝাবে কে? সে তো এসেছে গ্রেট ব্রিটেন থেকে - যে দেশের প্রস্থ সাকুল্যে চারশো সাইত্রিশ কিলোমিটার।

ইংরেজ ক্রিকেটারদেরও তথৈবচ অবস্থা। বেড়াতে বেড়িয়েছিল। ট্রেন লাইনের পাশে কাঠের স্লিপার দিয়ে পিচ বানিয়ে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলছিল। ছেঁড়া বল আর চ্যালা কাঠের ব্যাট দেখে ভারি আমোদ হয়েছিল সায়েবদের। তাই দাঁড়িয়ে পড়ে খেলা দেখছিল সবাই। এমনিই প্র্যাক্টিস করছিল ওরা। সাত-আটটা ছেলে, দুটো টিমে ভাগ করাই মুশকিল। ইচ্ছে হয়েছে, ব্যাটবল খেলছে। হঠাৎ দর্শকদের খেয়াল করে তারা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একটা লম্বা ছোকরা এসে বলল, "ক্রিকেট খেলবে? ব্যাটবল আমাদের, তাই আমরা অস্ট্রেলিয়া হব, তোমরা ইংল্যান্ড কিন্তু”।
ইয়ার্কির একটা সীমা থাকা উচিত।

অবশ্য ব্রিটিশদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, নিজেদের দিকটাও দেখতে হবে। ফার্স্ট টেস্টের সেকেন্ড ইনিংসে ৬৬ রানে বান্ডিল। তার মধ্যে উডফুল ওপেন করতে নেমে তিরিশ, আসল হিসেবে নটা উইকেট ছত্রিশ রানে পড়েছে। ব্র্যাডম্যান মোটে এক। জীবনের প্রথম টেস্টের সেই হতাশা মাখা ড্রেসিংরুম সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। ড্রেসিংরুম থেকে কোনওরকমে শরীরটা টেনে বার করে নিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল, কেলওয়ে রিপোর্টারকে বাইট দিচ্ছে - কথা হচ্ছে ব্র্যাডম্যান ছোকরার টেস্ট ভবিষ্যৎ নিয়ে। ব্যাটা বুড়ো ভাম বলে কিনা, “Bradman is not up to test standard”. হয়তো সত্যিই তাই, পরের টেস্টে তো বসিয়েই দিলেন নির্বাচকরা।

Friday, February 1, 2019

Lemon Tree

When I was just a lad of ten, my father said to me
"Come here and take a lesson from the lovely book fair spree"
"Don't put your faith in facebook, my boy" my father said to me
"I fear you'll find that facebook is like the book fair spree"

Book fair spree, very pretty, and the fresh book is sweet
But the price of the good book is impossible to forfeit
Book fair spree, very pretty, and the fresh book is sweet
But the power of the good author is impossible to forfeit

One day midst the book fair spree, my love and I did lie
A blue light so sweet that when she 'liked', the stars rose in the sky
We passed that summer lost in love, beneath the book fair spree
The music of likes and thumbs up hid my father's words from me

One day the likes left without a word, comments took away the sun
And in the dark facebook left behind, I knew what she had done
She left me for another, it's a common tale but true
A sadder man, but wiser now, I sing these words to you

Book fair spree, very pretty, and the fresh book is sweet
But the price of the good book is impossible to forfeit
Book fair spree, very pretty, and the fresh book is sweet
But the power of the good author is impossible to forfeit