Saturday, October 25, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ: "সি ফুড"

দেখুন স্যর, ট্রাভেলগ তো অনেক পড়েছেন। ছাপা, বাঁধানো, সুন্দর সুন্দর ছবি দেওয়া। আপনার জন্য আমাদের ব্লগ কোম্পানি বিনে পয়সায় এই ট্রাভে-ব্লগের ব্যবস্থা করেছে।

ইন্টারনেটে রোজ'ই তো কত্ত কিছু পড়েন। আমার এই পাতা নেক্সট্‌ ক্লিকেই চোখের সামনে থেকে উড়ে যাবে।

পড়া না পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু একটু পল্লবগ্রাহিতা তো করে দেখুন।

কারেকশনঃ আগের প্যারায় যা লিখেছি, দয়া করে ভুলে যান। পড়া না পড়া আপনার নয়, বেশ কিছু দিন হল আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস, খারাপ মানুষ তো বিশেষ করে। সুতরাং ব্লগ পড়ে আপনাদের কেমন লাগলো সেটা না জানালে, আকুপাকু অবস্থা এবং শেষমেষ আকুপাংচার।

ট্রাভেলগ হওয়ার কথা ছিল বোস্টনের, কিন্তু এখনও দেশ ছেড়ে বেরোনো হয় নি। নিজগুণে ক্ষমা করবেন, প্লিজ।

আর হ্যাঁ, প্রথম আর দ্বিতীয় সংখ্যা এখানে রইলো। যেহেতু আমরা কোন নির্দিষ্ট টাইমলাইন অনুসরণ করছি না, এখন থেকে শিরোনামে সেই পর্বের কোন ক্যাচলাইন দেওয়া থাকবে।

হ্যাঁ, এই আইডিয়া'টা ফ্রেন্ডস থেকে বেমালুম ঝাড়া।
--

আপনি কি সি ফুড খান?

মানে দায়ে পড়ে খান, না ভালোবেসে খান? যদি ভালোবেসে খান, তাহলে একটা গায়ে পড়ে সাজেশন - ইন্ট্যারন্যাশনাল ফ্লাইটে চাপবার অন্তত একদিন আগে আপনার পছন্দটা প্লেন কোম্পানিকে জানিয়ে দিন।

কেন?

উহু, কারণ টা শুধুই চিংড়ি বা টুনা অথবা স্যালমন প্রেম নয়। আসল কারণ হল গিয়ে লোভ।

পুরোদস্তুর হ্যাংলামো।

এয়ারহোস্টেস মহোদয়া যবে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আপনার কাছে আসবেন, গড়পড়তা পঞ্চাশ জন ততক্ষণে খাবার খুলে ফেলেছেন। প্রথম রো'তে অনেকেই ততক্ষণে ঢেঁকুর তুলতে শুরু করেছেন। আপনার পাকস্থলীতে অভ্রান্ত নিশানায় সুগন্ধের কার্পেট বম্বিং শুরু হয়েছে

কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।

যদি না আপনি আগে থেকে স্পেশাল অর্থাৎ কিনা স্বাভাবিক নয় এরকম কিছু অর্ডার করে রাখেন।

অস্বাভাবিক খাবারের লিস্টি অবশ্য ছোট নয়। হিন্দু মিল, মুসলিম মিল, সি ফুড, জৈন মিল ইত্যাদি ইত্যাদি।

জুরিখ থেকে দুবাই এর ফ্লাইট পাকড়ানোর আগে বন্ধু -কাম-ভাই-কাম-অঙ্কের-গবেষক একজন'কে একবার এই সেম জ্ঞান পাস করেছিলাম। ছেলে বুদ্ধিমান এবং এক্সপেরিমেন্টাল, এবং জাজমেন্টাল।

আচ্ছা, হিন্দু মিল নয় কেন?

প্লেন কোম্পানি হিন্দুমাত্রেই শাকাহারী ধরে নেয়, তারপর লাঞ্চ বক্সটা কালাহারি'র মত ধু ধু করে কিনা, তাই।

হুম, তাইলে মুসলিম মিল কি দোষ করল?

এবার আমার মাথা চুলকানোর পালা। ইয়ে, না মানে দোষ কিছুই নয়। আসলে যাবতীয় ধর্মীয় ব্যাপার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখাটাই আমার মতে সেফ এন্ড সিকিওর।

একদম ডাহা মিথ্যে কথা। খাওয়ার জন্য এ শর্মা অনেক নিচে নামতে পারে, ধর্ম ইনক্লুডেড।  মাস্টার ডিগ্রী পড়াকালীন পরবাসী শিক্ষার নিয়ম মেনে দিনের দিনের নিজেকে রান্না বান্না করেই খেতে হত। বাংলার মাস্টারমশাই কে মনে পড়ত, অদ্যভক্ষ ধনুর্গুণ কথাটার মানে হাড়ে হাড়ে টের পেতাম। তাই সুযোগ পেলেই ধর্মীয় স্থানে গিয়ে চারটি খেয়ে আসতাম।

চার্চ, মন্দির, মসজিদ সর্বত্রই। পাপী তাপীদের কোনো স্থিরতা থাকে না।
নেহাত আমি যে শহরে থাকতাম সেখানে গুরদোয়ারা ছিল না তাই।

মন্দিরে মিষ্টি, ফল।
চার্চে কেক, ফল।
একমাত্র মসজিদ’ই আমার টেনাসিটির মান রাখতো - ভেজ পিৎজা।

ইতালির গা ঘেঁষা সেই সুইস শহরে বেগুন বা ফুংগি (মাশরুম) পিৎজার স্বাদ'ই আলাদা। বাংলাদেশী অথবা নিদেনপক্ষে ওদেশী বাড়িতে পাত পেড়ে সর্ষে ইলিশের মত। অথেন্টিক এবং রিলায়েব্‌ল।

তো স্বভাবতই প্লেন কোম্পানির ঘোষিত মুসলিম ফুড খারাপ হওয়ার কথা নয়। সুতরাং মুসলিম মিল ট্রাই করা যেতেই পারে, ইন ফ্যাক্ট ট্রাই করা উচিত।

সেইমত সিলেক্ট করা হল। আমি সি ফুড, বন্ধু মুসলিম ফুড।

অবশেষে শুভযাত্রার দিন এল। প্লেনে চাপলুম, খানিক এদিক ওদিক করার পরে প্লেন যখন গোঁত্তা খেয়ে পূবে বাঁক নীল আর জুরিখ লেকের শেষটা মিলিয়ে গেল, বিমানসেবিকা আসলেন।

সি ফুড স্যার?

ইয়েস প্লিজ।

মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো তো। প্রতিবার ভাবি এতবার যাচ্ছি, এবার নিশ্চয়ই লবস্টার আর ক্যাভিয়ার দেবে। যথারীতি টুনা পড়েছে কপালে, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের ইকনমি ক্লাসে এর চেয়ে বেশী আতিথেয়তা জুটবে না।



আশেপাশের সিটে একটু আলোড়ন উঠলো। আমাদের লাইন ভেঙ্গে খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা।

কিছুক্ষণ পরে আমার বন্ধুর সামনে এসে, রক্তকেশী - এন্ড ফর ইউ স্যার, ইজ ইট মুসলিম মিল?

হ্যাঁ।

আমরা দুজনেই সাগ্রহে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত কষ্ট করে, অবিকল অধুনা লুপ্তপ্রায় অজন্তা সার্কাসের সুন্দরী ট্রাপিজ নর্তকীর মত, নয়নাভিরাম ব্যাল্যান্স করতে করতে, একটা স্ট্যান্ডার্ড প্লেটে, অসম্ভব বিশাল মুর্গীর গোটা রোস্ট ও তৎসহযোগে বিড়াল-না-ডিঙ্গাতে-পারা ভাত, রুটি, কাবাব ইত্যাদি উপুড় করে দিলেন। একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই পরিমাণ খাওয়া অসম্ভব। বাজী রেখেও নয়।

মুসলিম ফুডের বদান্যতায় আমি আপ্লুত। অভিভূত।

আমার বন্ধুটি আবেগতাড়িত হয়ে যেই না মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, বাব্বা, সো মাচ ফুড। ট্রাপিজ নর্তকী থুড়ি বিমানসেবিকা মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, এমিরেট্‌স অলওয়েজ টেকস্ কেয়ার অফ ইয়োর স্পেশাল নিড, স্যর। সিন্স ইউ ফাস্টেড ফর দ্য লাস্ট সিক্সটিন আওয়ারস, প্লিজ কন্সিডার দিস ……

ফাস্ট??
কে করেছে?
কবে?
কোথায়? কেন

বললাম না বরাবর’ই ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপার থেকে দূরে থাকি। তাহলে ফাস্টের প্রসঙ্গ আসছে কেন?
এয়ারপোর্টে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় কিছুই বাদ দিই নি। দু’জনেই। এবং সেটা রীতিমত বিগত ষোলো ঘন্টার মধ্যেই হয়েছে।

হঠাৎ জটায়ু - হাজার ভোল্টের স্পার্ক। ও হো, এ তো রমজান মাস।
একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম যে প্লেনে অব্দি মুসলিম মিল ছাড়া খায় না, তার তো এটুকু যত্ন প্রাপ্য। সারা দিন উপবাসে রয়েছে বেচারা।

উজ্‌ ইউ লাইক টু হ্যাভ এনি ড্রিংক স্যার?

বন্ধুবর খাবারের বিশাল প্লেটের দিকে তখনও হিপ্নোটাইজ্‌ড হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।

এক্সকিউজ মি স্যর, হুইচ ড্রিংক ফর ইউ?

হুইস্কি প্লিজ। ওনলি সোডা, নো ওয়াটার।

অনেক অন্যান্য অনুভূতির মতোই চমক সাধারণত একদিকে হয় না। ব্যাপারটা হাই তোলার মত, ছোঁয়াচে। যত পরেই হোক, আসবেই আসবে।

যে শান্ত বিমানসেবিকা দু'কিলোর ডিনার সরবরাহ করে আমাদের যারপরনাই চমকে দিয়েছিলেন, তিনিই এবার হাঁ। আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন, ডিড ইউ সে হুইস্কি স্যার?

বন্ধু কনফিডেন্ট। ইয়েস প্লিজ।

যে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মানুষটি প্লেনে ওঠার আগে মুসলিম মিল অর্ডার করতে ভোলেন নি, তাকে সুরা সার্ভ করতে ভদ্রমহিলার একটু বাধো বাধো ঠেকছিল।

ভ্রাতৃপ্রতিম ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, কি অনির্বাণ’দা? কেমন হল?

প্লিজ হাত লাগাও। গোটা মুর্গী সাবাড় করা আমার কম্মো নয়। যাইহোক খাবারটা একঘর দিয়েছে, কি বলো? এরপর থেকে তো তুমি সি ফুড ছেড়ে মুসলিম মিলের দিকে ঝুঁকবে?

নাহ্‌ ভাই আমি ঝুঁকি নিয়ে ঝুঁকতে পারবো না রে। আমার সি ফুড বেঁচে থাক।

কেন? সি ফুড কেন? ঝুঁকি কিসের?

কারণ, নাই মামার থেকে কানা মামা ভাল।

মানে?

মানে এটা ডিনার বলে ডবল খাবার পেলি। লাঞ্চ হলে?

এক গ্লাস জল জুটত, টেনেটুনে জুস।
--

কিছুদিন আগে ব্লগ অ্যানালিটিক্স সংক্রান্ত একটি জ্ঞানের লেখা পড়লাম - তাঁরা বলেছেন, পাঠক’কে যদি আপনি গঁদের আঠা ছেড়ে ফেভিকলের আঠা ধরাতে চান তাহলে মিনিমাম একটা শব্দসংখ্যার লেখা লিখতেই হবে। তাঁর থেকে কম - নৈব নৈব চ।

ফেভিকল’কে ফেভি কুইকে পরিণত করতে গেলে নিয়মিত লিখতে হবে। পাঠককে আমি আছি, আমি আছি।

মোদ্দা কথা পোচ্চুর পরিশ্রম করতে হবে। অতএব এখানে শেষ না করে হাজার শব্দ অতিক্রম করতে চাইছি। আটখানা গানেও ফিতে না ভরলে যেমন টেপের শেষে ফিলার থাকতো, এবং অনেক ভালো জিনিষের মতোই প্রযুক্তি যাকে কেড়ে নিয়েছে, সেই ফিলারের শরণাপন্ন হলাম।
--

প্রায় সব ভারতীয় বিদেশযাত্রার সময়ে, লাগেজে করে প্রচুর ভারতীয় খাবার বিদেশে নিয়ে যান - এই ধরণের খাবারের রেঞ্জ অসামান্য - রাহুল দ্রাবিড়ের তূণেও এর থেকে কম শট আছে। মুড়ি, ম্যাগি, মিষ্টি থেকে শুরু করে হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, তেজপাতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার ব্যাগে যেমন থাকতো ইঁটের মতো শক্ত ফ্রজেন, লোটে মাছের ঝুরা। যারা জানেন না, তাদেরকে আমি জানাতে চাই না, কারণ ওপরের সিক্রেটের মত এটাও ফাঁস হয়ে গেলে মুশকিল।

মাছ’টা তাহলে আর পঞ্চাশ টাকা কিলো থাকবে না।

তো এরকম আমার দুই বন্ধু শর্ট টার্ম ট্রিপে আম্রিকা গেছে। একজন সিনিয়র, একজন জুনিয়র। বয়েসের পার্থক্য প্রায় দশ বছর। দুজনেই পাঁচ কিলো করে বিস্কুট নিয়েছে। প্ল্যান পাকাপোক্ত।

ট্রানজিট এয়ারপোর্টে পৌঁছে বড় বন্ধু ছোট বন্ধুর কাছে বিস্কুট চাইল।
ক্যারি-অন লাগেজ থেকে বিস্কুট বার করতে করতে অত্যন্ত বিরক্ত  মুখে ছোট বন্ধু বলল,

কলকাতায় তখন পইপই করে বললাম, পুরো বিস্কুট’টা চেক-ইন লাগেজে ঢুকিয়ো না। এবার বোঝো। শিকাগো আসার আগেই বিস্কুট ফুরিয়ে গেলে খাবেটা কি?
— 

কথা দিচ্ছি, এর পরের সংখ্যাতেই আমরা বোস্টন ছোঁব।
অবশ্য আপনারা হলেন কিনা প্রিয় পাঠক, আমি ভুল করলেও আপনারা মানিয়ে নেবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে।
ষোলো আনা।

Friday, October 17, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ (দ্বিতীয় পর্ব)

খুব এলোমেলো একটা ট্রাভেলগ হচ্ছে, যেটা প্রথমে মনে পড়ছে, সেটাই প্রথমে লিখে ফেলছি। কোন ক্রনোলজিক্যাল অর্ডার মানছি না। প্রথম পর্ব মোট চারজন পড়েছে, তারমধ্যে আমি একজন। আপনি যদি নতুন পাঠক হন, তাহলে জানাবেন কেমন লাগলো, পুরনো পাঠক হলে তো কথাই নেই।
--

আমেরিকা থুড়ি আম্রিকা হচ্ছে স্বপ্নের জায়গা - এটা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে। আপনি অলরেডি সত্যিটা জেনে থাকলে তো ভালোই, নইলে এই বেলা জেনে নিন। মেনেও নিন, নইলে পস্তাবেন।

পস্তেছি তাই বলছি।

কিভাবে?
আমার এক জুনিয়র সহকর্মী (সহকর্মিনী কথাটা কি ঠিক?) যেদিন শুনলো আমায় ভিসার জন্য ইউ এস এম্ব্যাসী যেতে হবে, আরো অনেকের মত আমার পাসপোর্টে দশ বছরের ছাপ নেই, সেদিনকেই বেচারির ভ্রুজোড়া কুচকে গেসলো। 

মেয়েটি ইউ এস এ নিয়ে একটু অবসেসড। 
সেখানেই ভবিষ্যতে থাকবে, বুড়ো হবে, মারা যাবে - এইরকম সহজ সরল প্ল্যান। ইন ফ্যাক্ট, আমার পচা গলা মনের দৃঢ় বিশ্বাস - চেনা জানা আরো অনেকের মনের মধ্যেই এই একি স্বপ্ন দিন রাত চলেছে, এই মেয়েটির অন্তত: সাহস রয়েছে নিজের স্বপ্নটা খোলা গলায় সবাইকে জানানোর।

কিন্তু আমি সেই স্বপ্নভঙ্গ করলাম।
যখন কথাবার্তায় বেরোল, এইটেই আমার প্রথম ইউ এস ট্রিপ (হলেও হতে পারে, তখন ও ভিসা ইন্টারভিউ হয় নি), সেই কোলিগ আমার দিকে চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।



একজন একত্রিশ পেরোনো ইঞ্জিনীয়র, যে নিজেকে মোটামুটি শিক্ষিত বলে দাবি করে, অফিসের জনশ্রুতি অনুযায়ী গত আট বছর ধরে বিদেশে চক্কর মেরেছে, পড়েছে, পড়িয়েছে, চাকরি করেছে, জ্ঞান দিয়েছে এবং প্রচুর জ্ঞান শুনেছে - সে ইউ এস কখন ও যায় নি? 

হোয়াট দ্য হেল? ইজ ইট পসিবল ইভেন প্লজিবল টু এনিওয়ান?

সেই তীব্র হতাশা মাখা মুখ আমি ভুলবো না।

অবশ্য হতাশার তখনো ঢের বাকি ছিল। সকাল সাতটায় ইউ এস এম্ব্যাসি যেতে হবে। শোফার নেই আমার, তাই সেল্ফ ড্রাইভ। তবে একা নয়। টমটম ও নেই আমার, সেই কাজটা হাসিমুখে সোহিনী করে থাকে। আমার স্ত্রী।

দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌছে বার দুয়েক গোল গোল হয়ে একইরাস্তায় বার দুয়েক চক্কর মারার পর যখন কমলেশ্বরের আলভারেজের মতন নেক্সট ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দিগনির্ণায়ক কিছু ফিট করা যায় কিনা ভাবছি, ঠিক তখন ই সোহিনী বল্লো গাড়ি পার্ক করে আগে কিছু খেয়ে নিই চলো।

আমাকে যারা বিন্দুমাত্র চেনেন, অথবা চেনেন না, তারাও সম্ভবত জানেন, আমি অত্যন্ত লোভী প্রকৃতির মানুষ। এ ধরণের প্রস্তাবে আমায় পেড়ে ফেলা খুব সহজ। সেই ছোটবেলাতেও শুনতাম ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, অচেনা কেউ কিছু খেতে দিলে খাবে না। শুধু খাওয়াতেই নিষেধাজ্ঞা। কেউ কোনোদিন বলে নি অচেনা কারুর সাথে কোথাও চলে যেও না, জানা ছিল ইন্সেন্টিভ অফার না করলে সে গুড়ে বালি।

কোথায় গাড়ি পার্ক করব বল তো?
এই তো ওই খানে, পুরির দোকানের পাশে।

এটা তো ক্যামাক স্ট্রীট - কলকাতার রাস্তাঘাটে পার্কিং নিয়ে আমার বিলক্ষণ ভয় আছে।
ত্তুর, রাখোতো। সকাল সাড়ে সাত'টা, কেউ নেই। পার্কিং শিওর আলাউড।

কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পুরি তরকারি সাটানো হল। তারপর দোকানী কে এম্বেসীর পথ জিজ্ঞেস করতে, সে জানালো,

সোজা নাক বরাবর হাটতে থাকুন। বাদিকে চোখ রাখবেন। যেখানে দেখবেন কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ বসে জটলা করছে, ওই বাড়িটায় ঢুকে পড়বেন।

এইরকম সহজ এফেক্টিভ গাইডেন্স একমাত্র চাঁদের পাহাড়ে কমলেশ্বর'ই দিতে পেরেছেন। কখন বুঝবেন 'বই'টা শেষ হচ্ছে? রজতাভ থুড়ি বুনিপ পটকে গেলে? উহু একি বাজারি সিনেমা পেয়েছেন নাকি? যখন দেখবেন দেবের মুখমন্ডল শ্মশ্রুশোভিত - তখনি বুঝে নিতে হবে এই হয়ে এসেছে, নেক্সট ক্লিন শেভেই সিনেমা খতম।

চাঁদের পাহাড় নিয়ে আমার প্রচুর বক্তব্য আছে, মানে কমলেশ্বরের চাঁদের পাহাড় নিয়ে। এই পোস্টে সেদিকে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। শুধু এটুকু বলা যায়, মানিকবাবুর গণশত্রুর সেটে চাঁদের পাহাড় বানালে আর মগনলালকে বুনিপের পার্ট দিলেও এর থেকে ঢের বেশী জমত। অবশ্য মানিকবাবুর কাছে বাংলা সিনেমা ঠিক যতটা ঋণী, পারিবারিকভাবে তার থেকে একটু বেশীই উশুল করে নিচ্ছেন তাঁরা। প্রথমে ভয়ঙ্করী আমাদের কথা, ফলোড বাই একের পর এক ফেলুদার গল্পের হাড়িকাঠত্ব বরণ।

শেষ শুটিং হচ্ছে শুনলাম বাদশাহী আংটি।

জটায়ুর লেখাগুলো অপ্রকাশিত অবস্থায় আ বা প র কাছে সন্তোষ দত্ত রেখে যান নি? তাইলে তো অন্তত জটায়ুকে বেচে ফেলুদা বেঁচে যেত। একটা অবিবাহিত আপাদমস্তক ভালো লোকের এরকম অপমৃত্যু মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাক টু কলকাতা ইউ এস এম্ব্যাসি। সকাল সাড়ে সাতটা।

ভালো ইলিশ মাছ বেশী পরিমাণে উঠলে, কিলো প্রতি দর যখন তিনশো টাকায় নেমে যায়, তখন মফস্বলের মাছের বাজারে কিরকম ভিড় হয় দেখেছেন নিশ্চয়ই।

সেম জিনিস।

শুধু এরকম রোয়াব দু কেজি ইলিশের মাছ ওলার ও থাকে না। দোকানের বাইরে ক্রেতারা সব্বাই চুপটি করে, ভদ্র হয়ে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। সকলের হাতে বা বগলে ফাইল। কারুর মোটা ফাইল, কারোর সরু ফাইল, কারোর কারোর ভীষণ মোটা ফাইল। আমার সামনের ভদ্রলোক বিশাল কাগজের স্তুপ নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল ভিসা ইন্টারভিউ এর পরেই বোধহয় পুরোনো কাগজপত্র কিনে নেওয়ার বন্দোবস্ত থাকে, আর সেটা নিশ্চয় ডলারে। নইলে সাতসকালে কেউ স্বেচ্ছায় অত ভারী কাগজের বান্ডিল নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে পারে না।

সেই ভুল ভাংলো যখন মৃদু হাওয়ায় দুটো পাতা বান্ডিল থেকে খসে পড়লো। ভদ্রলোকের গত বছরের বাড়ি ভাড়ার রসিদ।

আমি নিশ্চিত আর একটু হাওয়া দিলেই কে সি পালের ছাতার বিলটাও বেরোত।

তাপ্পর মিনিট কুড়ি লাইন দিয়ে অবশেষে যখন ফুটপাত থেকে প্রথম গেট'টা টপকালাম, সামনের স্ক্যানারে সেই ভদ্রলোকের কে সি পালের কালো ছাতা ধরা পড়েছে। কালোটা সমস্যা নয়, ইউ এস এম্ব্যাসির ওরকম হাজারো কালো পতাকা দেখে অভ্যেস আছে। সমস্যা হচ্ছে ছাতার মেটালিক অংশ। স্ক্যানার কে সি পাল'কে মেনে নিতে রাজি।নয়, প্রবল বেগে ট্যাঁ ট্যাঁ করে আওয়াজ করছে। ভদ্রলোক মিনমিন করে সিকিউরিটিকে বোঝাচ্ছেন। সিকিউরিটি বেচারার বোঝার কিছু নেই, অসময়ের পুজোর বৃষ্টি কি শুধু কবিরাই টের পান? কিন্তু তার হাত পা বাধা। বড় সাহেব বারণ করেছেন।

স্ক্যানার পেরিয়ে আমার চোখ খুলে গেল। প্রথম বার ইউ এম্ব্যাসির কার্যকলাপ নিয়ে ধ্যান ধারণার সামান্য উন্নতি হল। ব্যাটারা মাল্টিপল বাফার লাগিয়ে ওয়েটিং টাইম এবং বিরক্তি দুটোই কমিয়েছে।

ফুটপাতে ভিসা প্রত্যাশীর সংখ্যা আদপে কিছুই নয়, ক্যাম্পাসের ভিতরে একদম মেলা দিলো কা আতা হ্যায়। শুধু আমীর খানের জায়গায় সুবেশী মার্কিন অ্যাক্সেন্টের তরুণী। ইংরিজীতেই বলছেন, তবে কিনা পাত্র ও পাত্রী বিশেষে বাংলা, মায় রাষ্ট্রভাষা অব্দি বলতে হচ্ছে। বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত। প্রবল জ্ঞানপিপাসু। কেন একজন আলিয়েন ইউ এস এ যেতে চাইছেন, তা নিয়েই ওনার থীসিস।
এই আলিয়েন ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই বেশ জ্বলে ছিল আমার। ইউ এস এরর রেসিডেন্ট না হলেই আপনি এলিয়েন। ফর্মে অন্তত তাই লেখা ছিল। ভীষণ যন্ত্রণার ঘটনা।

যাজ্ঞে, সে বাধা টপকানো গেলো। কাগজপত্র ও মুখের ভাষা ঠিক থাকলে ব্যাপারটা অত জটিল নয়। এই ঘরে অপেক্ষা করতে করতে ভিসাপ্রার্থী যাতে বোর না হন সেই কারণে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে। সব কটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন। রিসর্ট, র‍্যাঞ্চ, ঘর-বাড়ি, চাকরি - কিচ্ছুটি নয়, শুদ্ধু গ্র‍্যাজুয়েট ডিগ্রী। একদম কাস্টমার সেন্ট্রিক ফোকাসড আড। শেষ মুহূর্তে আপনি যদি ক ইউনিভার্সিটি থেকে খ ইউনিভার্সিটিতে লাফ মারতে চান। খ'তে মাঠ'টা বড়ো, পাশে নদী আছে - আর একটা নোবেল আছে।

বলা তো যায় না মানুষের মন বলে কথা।

এরপর আপনি এসে দাঁড়ালেন দিনের তৃতীয় সারিতে। এখানে একটা মক ইন্টারভিউ গোছের হচ্ছে। কাউন্টারে ডেকে নামধাম, ডেসিগনেশন জিজ্ঞেস করে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। নমুনা এরকম।

আপনার নাম কি?
মগনলাল মেঘরাজ।

আপনার পদবী কি?
আজ্ঞে, মেঘরাজ।

কিন্তু আপনার পাসপোর্ট তো তা বলছে না।
মগনলালের চোখে একরাশ অবিশ্বাস।

আপনার পাসপোর্টে লেখা আছে আপনার নাম মগনলাল মেঘরাজ, আর আপনার কোনো পদবী নেই।
মগনলাল চুপ।

অথচ আপনার ব্যান্ক আকাউন্ট অন্য কথা বলছে। সেখাবে আপনার পদবী মেঘরাজ। কোনটা সত্যি মগনলাল?
কানের পাশ দিয়ে গুনে গুনে ছটা গুলি চলে গেছে, মগনলাল আর বিশেষ  কিছু বলার অবস্থায় নেই।

আরেক কাউন্টারে আরেক ফ্লেভারের নামসংকীর্তন হচ্ছে।

আপনার নাম?
জয়া বচ্চন।

নাম?
জয়া।

পদবী?
বচ্চন।

আপনার ভোটার আই ডি কার্ড তো সেকথা বলছে না জয়া। সেই ডকুমেন্ট অনুযায়ী আপনার নাম জয়া ভাদুড়ী।
না মানে, ওটা আমার বিয়ের আগের নাম।
 
আপনার কি উচিত ছিল না বিয়ের পরে সমস্ত ডকুমেন্টে আপনার নাম'টা ঠিক করিয়ে নেওয়া?

এবার পাশ থেকে অমিতাভ টুকি দিলেন। 
হেঁই ... সরি ... এজ্ঞে ম্যাডাম, প্যান কার্ডে দেখুন জয়া বচ্চন করা আছে, ভোটার কার্ডে চেঞ্জ করা প্রচন্ড হ্যাপা। ইটস এ লেংদি প্রসেস।
মি: বচ্চন, আপনার স্ত্রী যদি নিজের নামটাও সমস্ত ডকুমেন্টে ঠিক করে দেখাতে না পারেন তাহলে উনি বিদেশে গিয়ে থাকবেন কি করে? আপনাকে ছাড়া যদি উনি চলাফেরা করতে না পারেন তাহলে তো ওনার দেশের বাইরে যাওয়া কাম্য নয়।

ইতিমধ্যে জয়ার কোলে অভিষেক কাঁদতে শুরু করেছে। অদ্ভুত সময়জ্ঞান। নাইন্টিজের সচিন-সৌরভের মত।
না বাবা না, তুমি লক্ষী হয়ে থাকো, কার্তিক হয়ো না।

নাম ধাম সমস্ত ম্যাচ করে যাওয়ায় তৃতীয় লাইনেও বিশেষ অসুবিধে হল না। এইবার আসল পরীক্ষা। চতুর্থ তথা অন্তিম সারি।
এখানে রিপ্লাই বাইনারি। হয় ভিসা হবে, নইলে নয়। মাধ্যমিক থেকে ইংজিনিয়ারিং - যেভাবে সবাই আগের পরীক্ষার্থীর প্রশ্ন শুনে নেয় - সে ভাবে শুনতে থাকলাম। কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন? কবে ফিরবেন? আদৌ ফিরবেন কি? ইত্যাদি...

সমস্ত উত্তর তৈরী। কিন্তু ওই যে পরীক্ষক আস্তিনের তলা থেকে বরাবর ক্ষেপনাস্ত্র বার করেন, তার অন্যথা হল না।

আপনার পাসপোর্টের পাতাগুলো এরকম ফিকে লাল কেন?
বছর পাঁচেক আগে মিলান এয়ারপোর্টে হঠাত বৃষ্টি নেমে বুক পকেট সুদ্ধ ভিজিয়ে দিয়েছিল, তাই। অনেক চেষ্টা করেও কলকাতা ইমিগ্রেশনের লাল স্ট্যাম্প থেকে কালি লিক করা আটকাতে পারি নি, তাই।

হুম, আপনি কদ্দিন ইউ এস এ থাকবেন?
আজ্ঞে, আটদিন মোটে।

এর আগে, ইউরোপে দেখছি আপনি ছয় বছর ছিলেন, চলে এলেন কেন?
বলতে ইচ্ছে করছিল, বেশ করেছি। 
বললাম, হোমল্যান্ড কলিং।

ইয়োর ভিসা ইজ আপ্প্রুভড, মি: দ্যাত্তা চ্যাউধুরি। আপনি এখন আসতে পারেন।

--

Saturday, October 11, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ (প্রথম পর্ব)

ইমিগ্রেশনের কাগজটা দিয়ে গেল। বাপ-ঠাকুর্দার ঠিকুজী কুষ্ঠী, কত টাকার জিনিস নিয়ে দেশে ঢুকছেন তার লম্বা ফর্দ।

ভদ্রলোকের টাকমাথা, নুয়ে পড়া চেহারা। দশটা-পাঁচটার সরকারী চাকরি করা বয়স্ক একজন মানুষ যেমন দেখতে হয়। একটু এদিক ওদিক দেখে, মাথাটাকে আরো কয়েক ইঞ্চি নুইয়ে দিয়ে, আমার কানের কাছে এনে, প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ে ... উইল ইট বি ওকে … যদি আমি … মানে … ইফ আই ... ড্রিঙ্ক ... দুত্তেরি ... মানে ... টেক সাম হুইস্কি।

আমি ঠিক সেই মুহূর্তে খুব বোদ্ধার মত স্কচ-অন-দ্য-রক্‌স ব্যাপারটা নামানোর চেষ্টা করছি। তবে কিনা ইকনমির টিকিট থুড়ি রেড লেব্‌ল, তাই অ্যাপেল জুস না মিশিয়ে ব্যাপারটা গলা দিয়ে ঢালা যাচ্ছে না।

এদিকের ঘটনা ঠিক পরিষ্কার নয়। আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে নুয়ে পড়া কাকু, নীল জ্যাকেটের সাইড পকেট থেকে, প্লেন কোম্পানির ছাপ মারা, রেড লেবেলের ছোট্ট প্লাস্টিকের বোতলটা একটুখানি বার করে দেখালেন।




ওঁকে কিছুটা থামিয়ে দিয়েই বলে ফেললাম, কাকু দু লিটার লিমিট, এয়ারহোস্টেস আপনাকে যেটা দিয়েছেন সেটা মোটে পঞ্চাশ এম এল। কাস্টম্‌স আপনার দিকে তাকিয়েও দেখবে না। ওরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না। আর আপনি তো রীতিমত উইদিন ইয়োর লিমিট্‌স। বুক ফুলিয়ে গট গট করে বেরিয়ে যাবেন।

আর হ্যাঁ, আমি বাংলা বলতে পারি। একটু আগে এয়ারহোস্টেসের সাথে ইংরেজীতে কথা বললাম, কারণ এয়ারহোস্টেস বাংলায় কথা বলতে পারেন না।
এবার একবারও ধাক্কা না খেয়ে সাবলীল নুয়ে পড়া কাকু, তুমি নিয়েচো? মানে হার্ড ড্রিঙ্ক্‌স নিয়েচো?

আচ্ছা যন্ত্রণা!
আমি কি সত্যিই দিন কে দিন সুবোধ বালক টাইপ দেখতে হয়ে যাচ্ছি? এরকম প্রশ্ন হঠাৎ?

বরফ আর স্কচের সূক্ষ্ম ব্যালান্সটা মুলতুবি রেখে ভালো করে তাকাতেই হল।
প্লেনের সিটে বসে থেকে অব্দি, ভদ্রলোকের নুয়ে পড়া চেহারাটা ছাড়া আর একটাও বিশেষত্ব চোখে পড়ে নি। গভীর রাতের ফ্লাইট, তাই দরজা বন্ধ করেই তড়িঘড়ি করে সব্বাইকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখনই প্রথম ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর শুনলাম।

উজ্‌ য়ু লাইক টু হ্যাভ অ্যা ড্রিঙ্ক স্যার?
স্বর্ণকেশী ছয় ফুটিয়ার দিকে তাকিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে নুয়ে পড়া কাকু, ইয়েস। ওনলি হার্ড ড্রিঙ্ক্‌স।

নুয়ে পড়া কাকু খুব মন দিয়ে এমিরেটসের ইকনমি ক্লাসের ভিডিওতে প্লেনের যাত্রাপথ দেখছেন। ওনাকে নুয়ে পড়া কাকু বলতে আর ইচ্ছে করছে না। নুয়ে পড়া কথাটার মধ্যে কিরকম একটা অসম্মান মিশে আছে।
অথচ প্লেনে উঠে অব্দি ভদ্রলোক ঘাড় নুয়ে বসেই আছেন।
আমি ভালো নাম দিতে পারি না। বিনয় করছি না, প্রুভেন সমস্যা। দু-একজন হলেও-হতে-পারে প্রেমিকার এরকম অভিযোগ ছিল।

আপাতত সুবিধের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক ওনার নাম নুপ কাকু।

নুপ কাকু প্লেনে উঠে থেকেই কড়া নজরে রেখেছেন পুরো সিস্টেমটাকে। মানে প্লেন বেচাল হচ্ছে কিনা, ট্র্যাফিক জ্যামে স্লো হয়ে যাচ্ছে কিনা। মাঝে মাঝে প্লেনের স্পিড আর টাইম টু ডেস্টিনেশন দিয়ে গুণ করে কলকাতা কদ্দুর সেই হিসেব করা। যদিও দূরত্বের হিসেবটাও রয়েছে স্ক্রিনে। একবার তো কয়েক'শো কিলোমিটার কম বেরোলো। একটু অস্থির হয়ে পড়লেন। কয়েক মুহূর্ত পরে গুই (গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস) রিফ্রেশ হতেই সব হিসেব মিলে গেল, আর মাছের-ওজন-কম-ধরতে-পারা আনন্দে নুপ কাকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বিড়বিড় করে বললেন, পথে এসো বাবা।
পাইলটকে উদ্দেশ্য করেই বললেন হয়তো।

আমি একটা মেন্টাল নোট নিলাম। অত্যাধুনিক প্লেনে এ ধরনের রিভার্স কম্যুনিকেশনের বিলক্ষণ প্রয়োজন রয়েছে। বেচারা পাইলটের তো জানা দরকার, লোকে শুধু গবগব করে চিকেন স্যালাড খেতে খেতে সিনেমা দেখে না, রিয়েল টাইম কড়া রিভিউ হয় রীতিমত।

ব্যাক টু প্রেজেন্ট টেন্স। এখন অবশ্য নুপ কাকুর চোখের ভাষা পড়ে নিতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না।
আমার তো মোটে একটা টি শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার। তাতে তো জ্যাকেটের জিপার দেওয়া পকেটের নিশ্চিন্ত আশ্রয় নেই। ‘হার্ড’ ড্রিঙ্ক্‌স আমি নিলাম কোথায়? র‍্যাদার, লুকোলাম কোথায়?

কাকুকে নিশ্চিন্ত করতে ব্যাখ্যা করতেই হল, মোটে চার লিটার সোমরস নিয়েছি, নিচে নেমে সহযাত্রী কোলিগের ঘাড় দিয়ে চালাবো বাকি দু লিটার। আমার মদ্যপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে মদ কোম্পানি একটা ট্রলি ব্যাগে যত্ন করে সব বোতল ভরে দিয়েছেন।
কাকুর মুখে প্রশংসাসূচক হাসি ভেসে উঠতেই টের পেলাম, পাস মার্ক্স পেয়ে গেছি। হয়তো বা ডিস্টিঙ্কশন’ও।

আসলে, জানো তো বন্ধুদের দেখাবো বলে, নিয়ে নিলাম।
সে বেশ করেছেন, কিন্তু প্লেনের মধ্যে একটা ড্রিঙ্ক নিলেন না কেন? আমি তো ভাবছিলাম একসাথে চিয়ার্স করবো।

না, আসলে আমি ভাবছিলাম সবাইকে একটা করেই বোতল দেবে ... কিন্তু তারপর দেখলাম ... এই তো তুমিই দুটো নিয়েছো। ওই সামনের সিটে ডানদিকে একজন চারটে নিয়েছে। আমি আসলে ...

ঠিক আছে, এখন একটা নিয়ে নিন।
চলে গেল যে? আবার ডাকবো? সিট বেল্টে হাত দিয়ে কেবিনের পেছন দিকে তাকালেন নুপ কাকু।

কোনো ব্যাপার’ই না, এই সুইচটা টিপলেই ওরা এসে খোঁজ করবে। সামনের ডিসপ্লের অসম্ভব জটিল ড্যাশ বোর্ডের মধ্যে থেকে সুইচটা খুঁজে বার করে, আপনার-সহযাত্রী-সব-জানে মুখ করে কাকুর দিকে তাকালাম।
না থাক।

এখন আর খাবো না।

প্লেন ইন্ডিয়া ঢুকে পড়েছে, সাহেবী ভদ্রতার আর প্রয়োজন নেই, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, সে কি? কেন?
না মানে ইয়ে ... তোমার ... মাসীমা। একসাথে সিট পাই নি। ওই পিছনের সিটে, এখনও জেগে আছে। বেশী রাত করে হার্ড ড্রিংক করলে ... আবার ...

বুঝেছি। ছেলে-মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছিলেন?

না, আমরা সবাই আলিপুর থেকে বেড়াতে এসেছি। মোট পঁয়ত্রিশ জন। কক্স অ্যান্ড কিংস। ইওরোপ ট্রিপ। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল। তো বেরিয়ে পড়লাম দু’জন মিলে।

কোথায় কোথায় গেলেন?
প্লেনে করে লন্ডন গেলাম। সেখানে দুদিন ছিলাম। তারপর সেখান থেকে বাসে করে প্যারিস, ওখানেও দুদিন। সেখান থেকে জেনেভা, তারপর ইটালি, মানে রোম। বেশ ভালো ঘুরিয়েছে। গাইড দিয়েছিল সঙ্গে। ভালো গাইড, হিন্দীতে কথা বলছিল।

কেমন ঘুরলেন?
বেশ ভালো। ঘুরলাম, খাওয়া দাওয়া বেশ ভালো ছিল। ব্রেকফাস্ট, কন্টিনেন্টাল ডিনার। মানে বেশ বাঙালি খাবার, চিকেন, ভাত। লাঞ্চটা অবশ্য নিজের। ওটায় একটু খরচা হয়ে গেল। তা হোক, অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল জানো, ইওরোপে ঘুরতে যাবো। ওরা আমাদের দেশে আসে, স্প্ল্যানেডে তো প্রায়ই দেখি ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেতে পারি না? তো এবার জানুয়ারিতে একটা এফ ডি ম্যাচিওর করলো, আমি গিন্নীকে বল্লুম, চলো – বয়েস হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে, আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না। তোমার মাসীমা অবশ্য গাঁইগুঁই করছিল, শাড়ি পড়তে দেবে কিনা।

আরে সে রকম গাদা গাদা ছবি তো ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাবেন।
না আমি ইন্টারনেট’টা ঠিক ... আমাদের সময় আসলে ওসব ... তবে ট্রাভেল এজেন্টের ব্রোশিয়োরে একটা ছবি ছিল। সেটা দেখিয়েই রাজী করালাম। চল্লিশ বছর ধরে চিনি তো ওকে। নইলে আসত’ই না। আর ওকে ছাড়া কখনও ...... মানে বাইরে ...


বুঝেছি।

--

কলকাতায় নেমে ই-বোলার ফর্ম ভরে, ইমিগ্রেশনের খেঁকুটে ভদ্রলোকের সামনে যাওয়ার আগে কি মনে হল, ঘুরে তাকালাম।
ওই তো কাকু দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনের পরে। সাথে মাসীমা।

আসি কাকু, পরের বার কিন্তু একসাথে চিয়ার্স করব।
ভালো থেকো বাবা। আবার দেখা হবে।

কলকাতায় নেমে গেছি। বাংলা কথা শুনতে আর কান খাড়া করে বসে থাকতে হবে না। কিন্তু তাও আরো একবার ঘুরে তাকাতেই হল। ওই তো নুপ কাকু তাকিয়ে আছেন, উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, ততোধিক উজ্জ্বল একমুখ হাসি। নুয়ে পড়া দেহ থেকে একরাশ ভালোবাসা বেরিয়ে আসছে।

কি দরকার ছিল নুপ কাকুর এই কথাটা বলার। আমি-উনি দুজনেই তো খুব ভালো করে জানি আর কোনোদিনই দেখা হবে না। কি করে হবে?

এতো মানুষ, এতো কথা।

“কিছুই তো আর যায় না শোনা, কার কথা কে বুঝবে বল/
বুঝতে হলে কথার মানে, চেনা পথের বাইরে চল।
তবুও কিছু যায় না বলা, শব্দ খেলায় কেবল ফাঁকি/
কথার পিঠে কথা সাজাই, আমরা এখন একলা থাকি।।”

(চলিবে, লেখার শিরোনাম খুব সম্ভবত মিসলিডিং - আমার বস্টন ট্রিপের ট্রাভেলগ)