(১)
১৮ ডিসেম্বর ২০২০
আমি বছরে ৮-১০টা টেস্ট খেলি। তার জন্য সারা বছর নিজেকে নিংড়ে প্র্যাক্টিস করি। আমার ব্যাটের জোরে আমি ভারতীয় টেস্ট টিমে অটোমেটিক চয়েস। কোনো মা বাবা কোচ ফ্র্যাঞ্চাইজির জোরে নয়। নিজের অধ্যবসায়ের জোরে। ক্যাপ্টেন আমার স্লো ব্যাটিং পছন্দ করে না - সেটা মিডিয়ায় বলেও ফেলে। কিন্তু আমাকে বাদ'ও দিতে পারে না। কারণ আমি ব্যাট করি, আর কিছুই করি না, ব্যাট'ই করি। বিদেশে ঘন্টার পর ঘন্টা বলের পালিশ তুলে বলটাকে ভেজা সাবানের মত তুলতুলে বানিয়ে দিই। তারপর আমরা সিরিজ জিতি বা ড্র করি।
ভুল বললাম, শুধু ব্যাটিং নয়, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩০-৪০ দিনের খেলায় যখন স্লিপে আমার মাথার ওপর দিয়ে ১৪০-১৫০ কিমি/ঘন্টা বেগে বল উড়ে যায়, আমি কয়েক মিলি সেকেন্ডের সিদ্ধান্তে লাফিয়ে সেটা ধরে নিই। আমার সতীর্থরা সেই একই দিনে হাফ ডজন সহজ ক্যাচ ফেলে। বোদ্ধারা আলোচনা করেন, নতুন রঙের বল দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কীনা। হচ্ছে হয়ত, কিন্তু ৩৬৫ দিন ধরে আমি এই মুহূর্তগুলোর জন্য মনসংযোগ করি, আমার নিজের কাছে। আমার ২০-২৫ বছরের বন্ধুদের বিজ্ঞাপনে যখন সোশাল, প্রিন্ট এবং ডিজিটাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে যায়, প্রতি সপ্তাহে তাদের রোজগারের হিসেব বেরোয় ফোর্বসে, তখন আমি বাড়িতে একটা বল ঝুলিয়ে ব্যাটের সুইট স্পটে লাগানোর চেষ্টা করি। আমার সারা গালে ব্রণের ক্ষত। কোনদিন সারানোর চেষ্টা করি নি। কারণ আমার ব্যাটের ব্লেড মাখনের মত পরিষ্কার। সেখানে লেগে বল বাধ্য বাচ্চার মত আমি যেখানে যেতে বলি চলে যায়।
আমি পূজারা, আমার খেলা প্রাণভরে দেখে নিন। কারণ আমিই দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স, দ্য লাস্ট ওয়াল স্ট্যান্ডিং। ভারতীয় ক্রিকেট থেকে ওই পদটা উঠে যাচ্ছে।
নাকি দাবিদার আছে আর কেউ? জানেন নাকি?
(২)
১১ জানুয়ারি ২০২০
(৩)
১৯ জানুয়ারি ২০২১
বয়েস বাড়ার সাথে সাথে বারবার নতুন প্রেমে পড়ে যাওয়া একটা রোগ। ভালো রোগ। কুড়ির সচিনকে দেখে যে ভেবেছিল প্রথম প্রেম টিকে যাবে, কবজির আজহারের দিকে সেই লুকিয়ে তাকিয়েছিল। তারপর ন্যাটওয়েস্টে জামা খুলতে দেখে একগাদা তাবিজ থাকা সত্ত্বেও সে চোখ ফেরাতে পারে নি। সুইং পিচে ভারতীয় দেওয়ালের গায়ে দমাস করে ধাক্কা খেয়েছিল। তারপর ঘোড়ার মত চুলের এক উইকেটকীপার যখন তরুণদের নিয়ে বিশের ক্রিকেটের বিষক্ষয় করে ফেলল আর ক্যান্সার নিয়ে রক্ত ওগলাতে ওগলাতে পঞ্চাশের বিশ্বজয়। ওহো পাগড়ি পড়া একটা রোগা ছেলে যে ভারতীয় অধিনায়কের চোখে না পড়লে কানাডায় ট্রাক ড্রাইভার হয়ে যেত, তার দিকেও দুষ্টুমিভরা হাসি দিয়েছিল। তারপর এল বিরাট ঔদ্ধত্যের প্রেম, চেজ করে ১৮৩ রান করে বুক চিতিয়ে জেতার প্রেম।
সেই প্রায়-চল্লিশ আজকে আবার প্রেমে পড়েছে। আঘাত চিহ্নের। ভিক্টর ট্রাম্পারের নাকি এরকম হত। স্টিকি পিচে একজন সমর্থকের উপহার দেওয়া নতুন ভারী ব্যাট নিয়ে টেস্টে ৭০ এর আশেপাশে রান করেছিলেন। সমর্থকটির একটি ক্রিকেট সরঞ্জামের দোকান ছিল, যদি ট্রাম্পার ভালো খেলেন তাহলে তার ছোট্ট দোকানের বিক্রি-বাটা বাড়বে। ট্রাম্পার ড্রেসিংরুমে ফেরত আসার পরে সাদা জামাটা খুলতেই বুক পিঠময় শুধু বলের সেলাইয়ের নির্মম লাল ছাপ।
গাব্বায় পূজারা জামা খুলবেন না। ওঁরা এরকম করেন না, অনন্ত লড়াই করেও করতে পারেন না। আজকে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ধীরতম হাফ-সেঞ্চুরি করেলেন। কিন্তু সেটা উনি জানেনও না, যেটা জানেন...
ক্রীড়াসাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য একবার আমায় রাহুল দ্রাবিড়ের গল্প বলেছিলেন। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের ট্রফি, চেক, ম্যান অফ দ্য সিরিজের গাড়ি, পোডিয়ামে উজ্জ্বল আলোয় হাততালির মধ্যে প্রাইজ - এসব উজ্জ্বল মুহূর্ত দ্রাবিড়কে টানে না। শুধুমাত্র একটা দৃশ্যকল্পের জন্য তিনি ব্যাট করেন। বল ব্যাটের মাঝখানে লেগে সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। ওই যে দড়িটা পেরোলো, গড়িয়ে গড়িয়ে, ওই শুভক্ষণের জন্যেই এত ঘাম, এত রক্ত।
আজ, পূজারা, আমার নবতম প্রেম যেন সেই অর্গাজমের স্বাদ পান। উইনিং শট। তারপর না হয় জামার নিচে, হেলমেটের নিচে সেলাইয়ের দাগের হিসেব করা যাবে। "Wait until you get to Gabba, mate" - টিম পেনের অমর উক্তি। এটারও হিসেব হবে।