Friday, June 5, 2015

একটি বাটির আত্মকথা

(১)
ঘটি বাঙ্গাল – এই তর্ক আমাদের প্রজন্মকেই বোধহয় শেষ নাড়া দিয়েছে। আমাদের প্রজন্ম বলতে আশির দশকের শুরুর দিকে যাদের ধরাধামে আবির্ভাব (পড়ুন প্রাদুর্ভাব)।

এর পরে, নব্বুইয়ের দশকে বা আরো পরে নতুন শতকে যারা এই পচা বাংলাদেশে জন্ম নিতে বাধ্য হয়েছে, তারা বেশীরভাগ’ই জন্মেই গ্লোবাল। তাদের বাবামা’রা এন-আর-আই, আর পারিপার্শ্বিক শিক্ষায়, স্কুলে হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে, তারা বেশীরভাগ’ই হয়ে উঠেছে আর-এন-আই – রেসিডেন্ট বাট নন ইন্ডিয়ান। আমি কিছু এইট নাইনে পড়া ছেলেমেয়েকে চিনি, যারা কলকাতা শহরে বাস করে মাছভাত খেতে লজ্জা পায়। এটা তাদের খামতি নয়। তাঁদের কিছু করার নেই। স্কুলে তাদেরকে মছলি খাওয়ার জন্য বুলিড হতে হয়, সেই হেনস্থার হাত থেকে বাঁচতেই শিশুদের এই করুণ প্রয়াস।

এই ভয়ঙ্কর টানাটানির মধ্যে যদি আবার ঘটি-বাঙ্গাল কি এবং কেন তাদের কাছে অনেক দূরের কোনো প্রসঙ্গ। অথচ এই ঘটি বাঙ্গাল বিভাজনের পেছনে যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে, সেটা তাদের পড়ানো যেতে পারত।

কলকাতার নামী স্কুলের ওয়েবসাইটে দেখেছি, ছাত্রদের ক্যাম্পাসের মধ্যে ইংলিশ আর হিন্দী বাদে অন্য ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ।

মছলিবাবারা বেনারস থেকে সন্তর্পণে বাংলায়, বাংলার সংস্কৃতিতে, মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে পড়ছে।

‘ছিপিয়েমের’ বাংলা-ভাষা-মাতৃদুগ্ধ আমল - জোনাল থেকে পলিটব্যুরো – সব নেতাদের ছেলে মেয়েরা বাংলার সাথে ইংলিশও পড়বে, শুধু সাধারণ কমরেডরা সম্পূর্ণ বাংলা মাধ্যমের স্কুল। ওই যে অ্যানিমাল ফার্মের নিয়মে ছিল – সাম অ্যানিমালস্‌ আর মোর ইকোয়াল।

মনে আছে, আজকাল পত্রিকার সম্পাদক, আমার ছোটবেলার স্পোর্টস জার্নালিসমের হিরো, অশোক দাশগুপ্ত। খেলা পত্রিকার সম্পাদক, কি ঝরঝরে ভাষায় লেখেন। মফস্বলের কিশোরের সমস্ত মনোযোগ, হার্দিক সমর্থন তাঁর প্রতিটি লেখাকে ঘিরে। তিনি নেমে পড়লেন বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে। সমস্ত দোকানের নাম বাংলায় রাখতে হবে। অত্যন্ত সাধু প্রস্তাব। সমস্যা হল ইমপ্লিমেন্ট করতে গিয়ে। দোকান ভাংচুর ইত্যাদি। যেটা সেদিনের স্কুল/কলেজ ছাত্র এই অধম কোনোদিন বুঝে উঠতে পারে নি, সেটা হল উনি খুচরো ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য না করে বড় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোয় দরবার কেন করেন নি।

অনেক পরে বুঝেছি কি দারুণ দ্বিচারিতা। বাংলা-ভাষা-মাতৃদুগ্ধ নিয়ে কাগজ তোলপাড় করে নিজের সন্তান’কে সাউথ পয়েন্টে ভর্তি করানো। কই একবারও তো আজকালের পাতায় দেখি নি উনি সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে ধর্না দিয়েছেন যে ভাই আপনাদের স্কুলের নামটা বাংলায় লিখতে হবে। ওই যে, সাম অ্যানিমালস্‌ আর মোর ইকোয়াল।

‘বাংলা-ভাষা-মাতৃদুগ্ধ’ বেশী খারাপ নাকি এই বাংলা-হীনতা বেশী খারাপ সেটা নিয়ে দারুণ থীসিস হতে পারে। মার্কেট স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে - শহর কলকাতায়, ইংলিশে অনুবাদ করা ফেলুদার বইয়ের কাটতি কেন আসল বাংলা বইয়ের থেকে বেশী।

সোনাগাছি থেকে সুন্দরবন, সানি লিওন থেকে সোয়াইন ফ্লু – বাঙালি তুমি কোথায় গেলে? সাড়া দাও ভাইটি।

(২)
ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়েই চাকরিতে ঢুকে পড়েছি। তিন চার বছরের দিদি দাদারা অফিসে গাইড করছে। সেরকম’ই এক দাদার বাড়িতে এক সান্ধ্য ভোজের আয়োজন। ব্যাপার স্যাপার কিছুই না, তখনও বিদেশ যাই নি তো - অল্প পরিচিত মানুষজনের মধ্যেও একসাথে খাওয়া দাওয়া করতে কোনো ‘অকেশন’ লাগত না।

চলে আসিস, কাল একসাথে খাওয়া দাওয়া করব। ব্যস্‌, এটুকুই যথেষ্ট ছিল।

তো ভালো। ঠিক মনে নেই, তিন চার জন গেছি। তার কিছুদিন আগেই সেই দাদার বিয়েতে খেয়ে এসেছি। বাড়িতে নতুন বৌদি, মফস্বলের যুবকের সদ্য বিবাহিত জীবন শুরুর ছাপ ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার ভাড়াবাড়ি জুড়ে। কিছু আসবাবপত্র মফস্বল থেকে এসেছে, কিছু হাল ফ্যাশানের। ডাইনিং টেব্‌ল এখনও পছন্দ হয়ে ওঠে নি। তাই মেঝেতে আসন পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা।

বৌদি খুব যত্ন করে ভাত বেড়ে খেতে দিলেন। অল্প ব্যবস্থা, যদ্দুর মনে পড়ছে, ভাত ডাল ভাজা, মুরগির ঝোল। শেষ পাতে মিষ্টি। বড়ো আন্তরিকতার ছোঁয়া। নিমন্ত্রিতদের গড় বয়েস বাইশ, এবং তারা আতিথেয়তায় বেশ মুগ্ধ।
মাংসের বাটিতে কবজি অব্দি ডুবিয়ে ঝোল ভাতে ঢাললাম। মুখে দিয়েই কিরকম সন্দেহ হল – বৌদি কি ভুল করে চাটনীর মধ্যে মাংস ঢেলে ফেলেছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনমিন করে বলেই ফেলব কি না ভাবছি। সাত পাঁচ ভেবে মুখ বন্ধ রাখাই স্থির হল। তাই বলে মাংস তো আর ছাড়া যায় না। ঝোল থেকে তুলে আলগা করে যতটা পারা যায় সাঁটিয়ে নিলাম।

সেই দাদাটি আজ দশ বছরের পুরনো বন্ধু।

পরে জেনেছি যে পাঁড় ঘটি বাড়িতে ওই রকম মিষ্টি রান্না করা হয়। আর কট্টর বাঙ্গাল বাড়িতে ঘটি রান্নার অতিরিক্ত মিষ্টত্বকে ব্যঙ্গ করা হয়।

যদি ঘটিতে রেসিপি ল্যাখতো, তাইলে হক্কল পাতার শ্যাষে একখান কতাই আইত – এইবারে এক থাবা চিনি ফ্যাইলা ঢাকা দিয়া দ্যান।

এর উল্টো দিকে আবার রয়েছে কাঠ বাঙাল – মানে চরম বাঙ্গাল, রে রে বাঙ্গাল। মাইর‍্যা কাইট্যা ফেলুম বাঙাল। এরকম একজনের সাথে (ইনিও কোলিগ, ভালো বন্ধু) জুরিখ শহরে পিৎজা খাব। কিন্তু খেয়ে উঠতে পারলাম না। পিৎজার টপিং কি বোঝা যাচ্ছে না। শুধু চিলি ফ্লেক্স বিদ্যমান, নিচের স্তরে কি আছে – মাশরুম না সালামি - সেটা দাদাগিরি জাতীয় অনুষ্ঠানে কয়েক লাখ টাকার প্রশ্ন হতে পারে।

পি সি সরকার সম সাবলীলতায় আমার সেই বন্ধু, চরম তৃপ্তি সহকারে, লঙ্কার পিৎজা উদরাস্থ করছেন। ইন ফ্যাক্ট, লঙ্কার পিৎজা কোনোদিন বাজারে এলেও, তাতে লঙ্কার পরিমাণ এর থেকে কম থাকবে। (পি সি সরকার আমার জীবনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন গত লোকসভা নির্বাচনের সময় – তাঁর স্লোগান ছিল – দিল্লীতে মোদী সরকার আর বারাসতে পি সি ...)

(৩)
বাবার দিক বাঙাল আর মার দিকে ঘটি হলে ছেলে মেয়ে নাকি বাটি হয়। তো চব্বিশ বছর আগে এই বাটি অনির্বাণ তো বুঝতে পারছে না – ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের মধ্যে কাকে সাপোর্ট করা উচিত। ক্লাস টু তে এটা প্রায় জীবন মরণ সমস্যা (তখন ছিল, এখন নেই)। সারা ক্লাস বিভক্ত – এক সাথে দুজনকেই সাপোর্ট করা যাবে না।

একানব্বই চলে এসেছে না? আমেরিকা সন্তর্পণে ঢুকছে – হয় তুমি আমাদের সাথে অথবা ওদের সাথে।

কি করা যায়? কি করা যায়? এত্ত ইম্পর্ট্যান্ট একটা সিদ্ধান্ত।

ঠাকুর্দা, ঠাকুমা – ময়মনসিং আর বরিশাল। অমোঘ কারণে এপারে এসেছেন। নিজেরা ভায়েরা যখন দেশের টানে কথা বলেন, আমরা বুঝে উঠতে পারি না কি বলছেন। তাঁদের সমর্থন কোনদিকে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ছোটবেলা থেকে বাবাও ইস্টবেঙ্গলেই নাম লিখিয়েছেন।

তাহলে মা’র টিমের কি হবে? শান্তিপুরের মার তো একটা সাপোর্টার দরকার। মা খেলা দেখে না, তাহলে মা’র টিম এমনি এমনি খেলবে? সাপোর্টার ছাড়া?

বুদ্ধিমান অনির্বাণ ক্লাস টু’তে সিদ্ধান্ত নিল তাহলে মোহনবাগানকেই সাপোর্ট করা যাক।

ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক।