Monday, February 8, 2021

দুয়ো রাজকন্যের গল্প

এটা দুয়ো রাণীর দুয়ো রাজকন্যের গল্প। বাংলা সাহিত্য মায়ের ক্রীড়া মেয়ে। 

২১শে ফেব্রুয়ারি সে তার বন্ধুনি ভাষাদিবসের হাত ধরে মন্ডপের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডের মস্তি দেখে। রাজকন্যে এখনো ভাবে একদিন তার মায়ের জন্মদিন’ও এভাবেই জাঁকজমক করে হবে। লেমন চিকেনের বদলে হয়ত কড়াইশুঁটির কচুরি হবে। 

তা হোক।

তার মার নামে এই শহর একদিন জ্বরে কাঁপত। সেদিন আর নেই। এখন শুধু বিদেশে মাকে নিয়ে গবেষণা হয়। মায়ের ছবি অবশ্য ২০% ছাড়ে কলেজ স্ট্রীটে বিক্রী হয়। কিন্তু মার কথা নাকী কেউ বুঝতে পারছে না আজকাল। 

তাই রোমান হরফে ছাপা, মার মত দেখতে কিছু পুতুল ছাপানো হয়েছে। না ইংরিজি বই নয়, রোমান হরফে ছাপা বাংলা সাহিত্য। বিখ্যাত প্রকাশনীর দামী বই Abol Tabol, by a certain Mr. Ray। 

চড়া সাজগোজ করা দুয়ো রাণীর ছবি ছাপা পাতায় পাতায় - “Kal korechhen ajob rakom Chondeedaser kurro… Uthlo kendey ‘gunga’ boley bheeshon attorabey”। 

শেষ শব্দটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল দুয়ো রাজকন্যে। বুঝতে পারে নি। বইয়ের তাক থেকে পুরনো লাল মলাটের বইটা ঝেড়ে ঝুরে বার করে, বেড়ালের ছবিটা উলটে, সন্তর্পণে বই খুলে দেখল লেখা আছে – “উঠল কেঁদে গুংগা বলে ভীষণ অট্টরবে”। সুকুমার দাদু দুয়োমেয়ের জন্মের আগেই মরে গেসল, কিন্তু কী চিরন্তন আজকেও – কালোত্তীর্ণ সাহিত্য বোধহয় একেই বলে। দুয়ো ক্রীড়া মেয়ে বাক্যটা আবার পড়ে আর নিশ্চুপে গুংগা বলে চোখের জল ফেলে।

এটুকু ভেবেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ক্রীড়া মেয়ের। পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। দুয়ো রাণীর প্রাসাদেই তার ঢোকার অনুমতি ছিল না এই সেদিন অব্দি। যেন জারজ সন্তান সে। শ্রী শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং শ্রী মতি নন্দীর প্রশ্রয়ে এই কয় দশক হলে দুয়োরাণির চাকর-বাকরেরা মেয়েকে প্রাসাদের দালানে বসে দুধ দুইতে দিয়েছে। কিন্তু দুয়ো রাণীমার চুলে চিরুণি চালানোর জন্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরদালানে ওঠার অনুমতি তার নেই।

বাড়ি ছেড়ে মনে দুঃখে চলেই গেছিল সে। কয়েকটা বাচ্চা ছোঁড়াছুঁড়ি মিলে জোর করে ভাঙা প্রাসাদের সামনে তাকে ফেরত এনেছে। তারা বলছে ক্রীড়া মেয়ের নতুন নাম দিয়েছে। তোমার নাম আর দুয়ো মেয়ে নয়। তুমি বাইশ গজের মধ্যেও আটকে নেই, তুমি বাইশ গজের বাইরে। 

সেদিন’ই অনেক দিন পরে  দুয়ো মেয়ে অবাক হয়ে শুনল কত মানুষ এখনো দুয়ো রাজকন্যের খোঁজ করে। সেই যারা ছোট্টবেলায় খেলা রাজকুমারের প্রেমে পড়েছিল, তারা। ২০১৫ তে খেলা রাজকুমার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মরে ফৌত হল। অবশ্য তার বছর দশেক আগে থেকেই খেলা রাজকুমারের শরীরটা খারাপ, কেউ খোঁজ’ও নিত না। 

সানন্দা, আনন্দলোকের মত লাস্যময়ী রাজকুমারীদের সামনে খেলা রাজকুমার ঠিক নিজেকে বিক্রী করতে পারে নি।

দুয়ো রাজকন্যে এই নতুন ছেলেগুলোর উদ্যোগে সামিল হয়েছে বটে। কিন্তু এই সেদিন হঠাৎ ঘাম দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। স্বপ্নে সে দেখেছিল, রোমান হরফে লেখা – “kamool, baleensTa haaraas na”। ‘বাইশ গজের বাইরে’ কি ব্যালান্স’টা ধরে রাখতে পারবে?

আমি যাকে ভালোবাসি, সে কাঁদে দুনিয়ার জন্য,

সে বড় একলা, অনন্য, বেশি বয়সের প্রেমের মত।

পৃথিবী যে নিয়মে চলছে, সে ঠিক সে নিয়মে চলে না,

তাকে সহজে বোঝা যায় না, তার ভাবনা অন্যরকম।