Monday, August 24, 2015

একশোয় একশো

অঙ্ক বরাবরই ভয় পাওয়ায়।

সেই কবে ক্লাস ফাইভে একবার একশোর একশো পেয়েছিলাম - তারপর থেকে শুধুই নব্বইয়ের ঘরে, কখনো আশির ঘরে, কখনো আরও লজ্জাজনক নিচে গোঁত্তা খাচ্ছি।

আশেপাশের স্কুলে সবাই জানে খড়দা রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের অঙ্কের প্রশ্ন হচ্ছে টেস্ট পেপারের দ্রষ্টব্য বিষয়। কি করে ছাত্রদের নাস্তানাবুদ করতে হয়, কোন অঙ্কের স্যার কতটা জব্দ করতে পারেন, তাই নিয়ে বছরভোর লড়াই। স্যারেরা বোধহয় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন - হুঁ, আপনি এবার ক'জনকে ফেল করিয়েছেন? ... মাত্র উনিশ জন। এ বাবা, এ তো কিসুই নয়। হেঁ হেঁ, পাঁচ বছর আগে কোয়েশ্চেন সেট করেছিলুম ... বুঝলেন, ছেচল্লিশ জন কুপোকাত। কান ঘেঁষে হাফ সেঞ্চুরি ফসকে গেস্‌লো। হেডু ডেকে পাঠিয়েছিল - বলে কিনা অমুকবাবু, এরকম করবেন না আর, রি-এক্স্যাম নিতে হবে শুধু শুধু। তারপর থেকে বলে কিনা একটু ঢিলা দিচ্ছি, নইলে এদের কি করে ঢিট করতে হয় ...

ক্লাস এইটে পড়তে পড়তে শুনলাম, পাশের সেকশনে একটি ছেলে দারুণ অঙ্ক করে। প্রচণ্ড শার্প, অঙ্ক দিলেই সাথে সাথে খস খস করে খাতায় সমাধান করে ফেলে।

আলাপ করার জন্য মনটা ছুঁকছুঁক।

একশোয় একশো একটা আলাদা ব্যাপার। কিরকম সব জানি সব জানি একটা ব্যাপার। স্যার যখন ক্লাসে অ্যানাউন্স করেন অমুকে এবার অঙ্কে একশোয় একশো পেয়েছে, কিরকম একটা শিহরণ খেলে যায়। পাশের সেকশনের ছেলেটা নিশ্চয়ই তার মানে কোটি কোটি বার একশোয় একশো পেয়েছে।
খোঁজ নেওয়া দরকার।

--
ক্লাস নাইনের কোচিং ক্লাসের সামনে জমায়েত বসেছে। ঠিক সকাল পাঁচটা পঁচিশে অলোকবাবু দরজা খুলবেন। অঙ্কের ক্লাস। রাশভারী টিচার, দিকে দিকে খ্যাতি।
গঙ্গার এপার ওপার, প্রাচীন কলকাতা, সদ্য কলকাতা, হবে-হবে কলকাতা, হলেও-হতে-পারে কলকাতা আর ভীষণ পচা আর মন-খারাপ-করা মফঃস্বল - সবখান থেকে পঙ্গপালের মত ছাত্র ছাত্রীর ভিড় লেগে থাকে।

ভর্তির চাপ সামলানোর জন্য অলোকবাবু কোচিং এ আসতে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের নাম টুকে নেন। তারপর গ্রেডিং করেন। ক্লাস এইটের রেজাল্ট বেরনোর পরে অলোকবাবুর কাছে নাম লিখিয়ে যেতে হয়। তারপর সায়েন্স গ্রুপে যে যেমন মার্ক্স পেয়েছে সেই অনুযায়ী সেরা চল্লিশ জন ছেলে-মেয়ে দুটি ব্যাচে পড়তে আসে।

স্যার খুব সময় মেনে পড়ান।
মানে দুটো ব্যাচ - দুঘণ্টা করে - একটা সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা, আরেকটা সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে নটা। কড়া নিয়ম - স্থানীয় বাসিন্দা হলে সকালের ব্যাচে, আর খড়দহ অঞ্চলের বাইরের ছাত্র ছাত্রী হলে সাড়ে সাতটার ব্যাচ। সাড়ে সাতটার ব্যাচের স্টুডেন্টরা কোচিং থেকে সরাসরি স্কুলে যায়। সাড়ে নটায় কোচিং থেকে বেরিয়ে কোনোমতে টিফিন মুখে গুঁজেই স্কুলে ছুট। স্কুল শুরু পনে দশটায়, তার আগে ফুটবল খেলার ওটুকু অবসর বড়োই দুষ্প্রাপ্য।

অলোকবাবু ঘোর সায়েন্টিফিক মানুষ - সায়েন্স শুধু পড়ান না, মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।
গরমকালে গায়ে সাদা ধুতির ওপরে,  ভেজা লাল গামছা জড়িয়ে বসে থাকেন। ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সবাইকেই অলোকবাবুর ওই টাক-এবং-খালি-গা-ফর্সা-রোগা-তুলসী-চক্রবর্তী-অবতার দেখতে হবে। কোন নতুন ছাত্র অথবা ছাত্রের গার্ডিয়ান যদি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ফেলে, তাহলে স্যার চটপট তাকে খানিক লীনতাপ এবং গরমকালে ভেজা গামছার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেন।

তারপর দুটো ব্যাচের মাঝখানে অন্য ঘরে গিয়ে শুকনো গামছা আবার নতুন করে ভিজিয়ে আনেন।
--

- এই তোদের সেকশনে কে কে অঙ্কে একশো পায় রে?
- এই তো সৌমেন পেয়েছে, দীপেন্দুও পেয়েছে। দীপেন্দু আবার পর পর দু বার।
- আচ্ছা, ওই ছেলেটা কে রে? শুনছি পটাপট অঙ্ক করে ফেলে, নামটা কি যেন? শীর্ষ? নাকি শীর্ষেন্দু? ও নাকি খুব ভালো অঙ্ক করে রে? ও একশো পায় নি?
- নাহ্‌ ও তো কোন বারই পায় না, ওই পঁচানব্বই, ছিয়ানব্বই, ব্যস্‌। একশো তো পায় না।
- সে কিরে? সেদিন রাজ যে বলছিল দুর্দান্ত অঙ্কে মাথা, তাহলে একশো পায় না কেন?
- সে তো ওর চোখের জন্য। প্লাস আট পাওয়ার, পরীক্ষার খাতা দেখতে পায় না, সম্পাদ্য উপপাদ্য করতে পারে না।
- এত শক্ত অঙ্ক করে আর ওই সহজ সম্পাদ্য করতে পারে না? ওটা তো মুখস্ত।
- না রে, করতে চেষ্টা করে, কিন্তু চোখে ভালো দেখতে পায় না তো। প্লাস নাইন পাওয়ার। অঙ্কটা করে, কিন্তু সাথে ছবিটা আঁকতে পারে না। স্কেল দিয়ে লাইন টানার চেষ্টা করলে অনেক দূর দিয়ে চলে যায়।

নব্বইয়ের দশকের মফস্বলের ছেলেপুলে তো - আমরা রুলার বলতে জানতাম না, স্কেল বলতাম।
--

ক্লাস নাইনে অ্যাডিশনাল অঙ্ক পরীক্ষা। অলোকবাবু প্রশ্ন সেট করেছেন। আভাস দিয়ে রেখেছিলেন - মারকাটারি ব্যপার হবে। অ্যাডিশনাল পরীক্ষা তো - পাশ ফেলের ব্যাপার নেই। তাই অঙ্ক স্যারের বিন্দুমাত্র নৈতিক বাধ্যবাধকতাও নেই যে কিছু প্রশ্ন কষে ফেলার মত রাখতে হবে।
একেবারে হা রে রে, কেটে ফেলে দে রে।

অ্যাডিশনাল অঙ্কে একটা প্রশ্ন থাকত - খুব সহজ, বুদ্ধি খাটানোর ব্যাপার কম, মাথা গুঁজে হিসেব করে যেতে হবে। সেই অঙ্কটাকে বলা হত ট্যালি মার্ক্সের অঙ্ক। কিছু সংখ্যা, তাদের mean, median, mode ইত্যাদি বার করতে হবে। একেবারে সহজ দশ নাম্বার।

কিন্তু অলোকবাবুর বোধ হয় সে বছর প্ল্যান ছিল একটাই - মাস মার্ডার। বড়ো দাদাদের মুখে গল্পে শুনেছি (আশির দশকে যারা মাধ্যমিক দিয়েছিল, এমনকি নব্বইয়ের শুরুর দিকে), সেই ব্যাচের অনেকেই স্কুলে পড়তে অ্যাডিশনাল অঙ্কে কিছু যোগ করে উঠতে পারে নি। অলোকবাবুর তখন বোধকরি ভরা যৌবন।
আমাদের বছরে অলোকবাবু সোনালি অতীত ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

তো সেই বারের ক্লাস নাইনে অ্যাডিশনালের প্রশ্নে ট্যালি মার্ক্সের অঙ্কে দেড়শোটা সংখ্যা ছিল। সহজ কথায় - করতে তুমি পারোই, দশ নাম্বার হাতের মুঠোয়, কিন্তু ঝাড়া দুঘণ্টা লাগবে তোমার। ওই দশ নাম্বার অর্জন করতে।

পুরো পরীক্ষা দুঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের, সুতরাং ট্যালি মার্ক্সের প্রশ্ন করার পরে ছাত্রের হাতে আর বিশেষ সময়ই থাকবে না। অর্থাৎ ছাত্র - তুমি কিছুতেই চৌত্রিশের বেশী পাবে না অর্থাৎ টোটাল মার্ক্সে কিছুই যোগ হবে না।
বেশীরভাগ ছেলেই তাই করেছিল। দশ-বারো-চোদ্দো পেয়েছিল, চৌত্রিশের কোঠা পেরোতে পারে নি। তাঁর আরও একটা কারণ - বাকি অঙ্কগুলোতে হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছিল না। এক বছর পরে মাধ্যমিকে এরাই নব্বই একশো করে বাগাবে - কিন্তু সেই দিন তখনো দূরে।

শুধু চারজন ছেলে চৌত্রিশের ওপর পেয়েছিল - সঠিক মনে নেই - বিয়াল্লিশ, পঞ্চাশ, একান্ন, আটান্ন - এরকম। তাদের সকলের মধ্যে একটা মিল ছিল, তারা সযত্নে ওই ট্যালি মার্ক্সের অঙ্ক এড়িয়ে গিয়ে অন্য অঙ্কগুলো সলভ্‌ করার সাহস দেখিয়েছিল।

কি মনে হচ্ছে? অত্যাচার? তাই তো? আমাদেরও তাই মনে হয়েছিল। তিন বছর পরে যখন আমরা সবাই বুঝলাম যে ওই পরীক্ষাটা আসলে অ্যাডিশনাল নাম্বার যোগ করার ব্যাপার ছিল না, একটা ভবিষ্যৎবাণী ছিল - তখন আমরা আর অলোকবাবুর কাছে আর পড়ি না, স্কুলজীবন খতম। ক্লাস টুয়েলভের শেষের দিকে আই এস আই - বি স্ট্যাট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরল। স্কুলের সকলের মধ্যে ঠিক ওই চার জনই চান্স পেয়েছিল। ওই যারা ট্যালি মার্ক্সের অঙ্ক করে নি।

সেই চার জনের মধ্যে একজন ছিল সেই ছেলেটি - ওই যে দারুণ অঙ্ক করত, কিন্তু একশো পেত না - শীর্ষেন্দু।
--

এরপর অনেক দিন চলে গেল। বাংলা লাল থেকে নীল সাদা হয়ে গেল, সচিন ব্যাট তুলে রেখে দিল। আর আমি একটা কনফারেন্সে বোস্টন হাজির হলাম।
ফেসবুকে নীল মেসেজ দপ দপ করছে, উইকএন্ডে নিউইয়র্ক আসবি? রোশনি, শীর্ষেন্দুর বৌ - আমাদের আদার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং অলোকবাবুর কোচিং এর আরেক সদস্যা।

অনেক সাধারণ বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়। ক্রেডিট কার্ডের বিল - ও থাক, আজকে নয়, পরে দেব। বাজারে ইলিশ কিনব নাকি থাক, মাটন'ই চলুক।
কিন্তু স্কুলজীবনের কাছের বন্ধুরা যখন ডাকে, কি করে জানি সিদ্ধান্ত নেয়ার নিউরনগুলো রাতের বাইপাসের ট্যাক্সির মত ছুট লাগায়।

ঠিক দশ মিনিটের সিদ্ধান্তে বাসের টিকেট বুক করে নিউইয়র্ক যাত্রা।
নিউইয়র্কে পৌঁছে চমকে গেলাম। আমেরিকার বাকি বোরিং শহর গুলোর মত নয় তো মোটেই? রাত বাড়লেই রাস্তাঘাট ভোঁভাঁ নয়, গিজগিজ করছে লোক। খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেট্রোর আশে পাশে ডাঁই করা কাগজ জমে আছে - একটা বেশ অগোছালো ভাব - কলকাতা মেট্রোর সাথে ফারাক করা যাচ্ছে না মোটেই। মানুষের ভিড়ের চোটে রাত দেড়টার মেট্রোর দরজা বন্ধ হচ্ছে না।
মেট্রো থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ওদের বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত দুটো। অত রাতে পৌঁছে গল্প। হঠাৎ খিদেয় পেট চুঁই চুঁই।

- এই তোরা খেতে দিবি না?
- আগে বলবি তো খেয়ে আসিস নি। রাত তিনটে বাজে, আমরা তো ভাবছি তোর ডিনার হয়ে গেছে।
আবার ইলিশ মাছ ভাজা, গরম ধোঁয়া ওঠা নরম ভাত। খেয়ে দেয়ে সোজা বারান্দায়। হাডসন নদীর ধারে ওদের নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। সতেরো বছরের জমে থাকা গল্প। গল্প এর মাঝে হয় নি তা নয়। দুধের স্বাদ যদি ঘোলে না মেটে, স্কাইপ কি করে মুখোমুখি আড্ডাকে রিপ্লেস করবে?

শীর্ষেন্দু এখনও অঙ্ক করে, কর্নেল থেকে পিএইচ ডি করে ও নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটি'তে অঙ্ক পড়ায়। শীর্ষেন্দুর চোখ এখনও ঠিক হয় নি। কিন্তু ও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে, সতেরো বছর পরে দেখা হওয়া ক্লাসমেট'কে নিতে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় রাত একটার সময় অপেক্ষা করে। ডিজিটাল ম্যাগনিফিকেশন ব্যবহার করে রাশি রাশি সায়েন্টিফিক পেপার পড়ে, লেখে।

- জানিস অনির্বাণ, আমি কর্নেলে ডক্টরেট শেষ করে অন্য অনেক ইউনিভার্সিটি থেকে অফার পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন রোশনি নিউইয়র্কে পি এইচ ডি করছে, তাই একটু কমা ইউনিভার্সিটি হলেও এখানেই চলে এলাম। রোশনির পি এইচ ডি শেষ হলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমরা ... আসলে ... শহরটার প্রেমে পড়ে গেছি। মানে ... আমি তো কোনোদিন গাড়ি চালাতে পারবো না, মানে আমার চোখের জন্য আর কি। আর গাড়ি ছাড়া এই দেশে ...

আমেরিকার অন্য কোন শহরে, এমনকি দেশেও আমি এভাবে থাকতে পারব না। কলকাতায় আই এস আই এর সামনে বাস ধরতে পারতাম না জানিস - বাসের নাম্বার পড়তে পড়তেই বাস ছেড়ে দিত। পরীক্ষা দেওয়ার সময় একজনকে আমার পাশে বসে লিখে দিতে হত। নিউইয়র্কে আমি মেট্রো ধরে স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারি, আমায় অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। ডিজিটাল আতশ কাঁচ ব্যবহার করে পড়তে পারি। একটু সময় লাগে, কিন্তু এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি। মোদ্দা কথা - নিউইয়র্ক শহর'টা আমার ভালো লাগে।

পরের দিন শনিবার - মহা মজা। শুধু গল্প আর রান্না, রাতে ওদের বাড়িতে অনেক বাঙ্গালি বন্ধু আসবে। পট-লাক, প্রায় বছর তিনেক পরে বিদেশে বাঙ্গালী জীবনের স্বাদ। গল্প, আড্ডা, পি এন পি সি, গান, কবিতা, মার্লবোরো, স্কচ - জমজমাট ব্যাপার। ওদের বারান্দা থেকে হাডসনের ওপরে সানসেট। সেদিন শুতে শুতে দেরি হয়ে গেল।

রোববারে ঘুম থেকে কেউ উঠতে চাইছে না - ঘুম চোখে উঠে, আগের রাতের খাওয়া দাওয়া দিয়ে ব্রাঞ্চ সেরে নিউইয়র্ক ভ্রমণ।

- ম্যাডিসন স্কোয়ার, এম্প্যার স্টেট - এসব দেখবি?
- না রে, বড্ড ভিড় - অন্য কিছু বল।
- বাঁচালি, নিউইয়র্কে এসে লোকজন যে ভিড় করে কি দেখে ওই সব। চ তোকে MOMA দেখিয়ে আনি।
- মমা কি রে?
- Metropolitan Museum of Art ...
- ও আচ্ছা, চ তাহলে। ওখান থেকে কি সেন্ট্রাল পার্কে যাওয়া যাবে রে? ঐ যে যেটা ফ্রেন্ডস'এ দেখাত।
- হ্যাঁ হ্যাঁ জলদি চ, মাঝে রাস্তায় খেয়ে নেব।


MOMA তে গিয়ে শীর্ষেন্দু, রোশনি আর আমি হুটোপাটি করছি। অনেক দিন বাদে যেন মফস্বলের স্কুলের একটা অংশ উঠে এসেছে। এই যেন মমা থেকে বেরিয়ে স্কুলে যেতে হবে, তাঁর আগে কোচিং ক্লাসের বাইরে যতটা হুল্লোড় করে নেওয়া যায়।

- ওরে তুই অ্যাদ্দুর এলি, কিছু একটা আর্কিটেকচার দেখে যা।
- আচ্ছা বল, কি দেখাবি? ভিড় কম, দূর থেকে দেখা যায় এরকম কিছু।
- চ, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখে আসি।
- বড় বজরায় চেপে সমুদ্রের মধ্যে থেকে দেখব।
- সময়ে কুলোবে রে? আজকেই তো বোস্টনে ফিরতে হবে, কাল সকাল আট'টায় ক্লাস - কিছুতেই মিস করা যাবে না।
- তবে ছোট জলদি। ফাস্ট মেট্রো ধরলে হয়ে যাবে।

নাভিশ্বাস তুলে ছুটছি আমরা তিনজন।

স্ট্যাচু ছুঁয়ে, সমুদ্রের দামাল হাওয়া মুখে মেখে আবার ছুটতে ছুটতে ওদের অ্যাপার্টমেন্ট। মেট্রো ধরে যাবার সময় নেই। আচ্ছা তুই ডিনার করে নে, আমি উবার ডাকছি - নইলে বাস মিস হয়ে যাবে। ডিনারটা ইথিওপিয়ান রেস্তোঁরায় করার কথা ছিল, হল না। ক্যাব চেপে টা টা বাই বাই।

নিউইয়র্ক ভ্রমণ খতম।

রোশনি আর শীর্ষেন্দু জানত না, আমার একটা হিডেন অ্যাজেন্ডা ছিল। নিউইয়র্ক যাওয়ার। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি বা মমা নয়, আমি নিউইয়র্কে অন্য একটা জিনিস দেখতে এসেছিলাম।

অবশ্য ওরা কি করে জানবে, আমি নিজেই তখন জানতাম না কি সেটা।
--

এখন আমি নিউ ইয়র্ক থেকে বোস্টন ফেরত আসছি। নাইট বাস।

সারাদিনের হুল্লোড়ের পর ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওই তো শীর্ষেন্দু সাইকেল চালিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটায় অলোকবাবুর কোচিং এ পড়তে আসছে।

শীর্ষেন্দু কাছেই থাকে কিনা। তাই ওকেও সকালের ব্যাচেই আসতে হয়।

গলির মোড়ে, গলায় মাফলার জড়িয়ে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেলে বসে, এক পা মাটিতে রেখে। কুয়াশায় খুব ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, ওটা মাফলার না হয়ে মাঙ্কি টুপিও হতে পারে। ঘরে থেকে বেরোনোর আগে মা জড়িয়ে দিয়েছে। অলোকবাবু সোয়া পাঁচটায় দরজা খুলবেন, এখন ভোর পাঁচটা। পনেরো মিনিট দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

মফস্বলের শীতের সকাল, হাতে বোনা সোয়েটার ভেদ করে আলতো কামড় বসাচ্ছে।

খুব মন দিয়ে আমি সতেরো বছর আগেকার অনির্বাণ'কে দেখছি - গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শীর্ষেন্দুর দিকে আর ভাবছে - আচ্ছা এই ছেলেটা এত ভালো অঙ্ক করতে পারে, কিন্তু স্যার'রা কেন ওকে একশোয় একশো দিচ্ছেন না কেন? সম্পাদ্য'টার বদলে ওকে অন্য কোন অঙ্ক দিলেই তো হয়। ও তো অন্য অনেক শক্ত অঙ্ক নিমেষে করে ফেলে।

--

অতীতের অনির্বাণ আসলে ভুল ভাবছে - সতেরো বছর পরে সে বুঝতে পারবে শীর্ষেন্দু আসলে কবেই একশোয় একশো পেয়ে গেছে।