Saturday, August 31, 2013

ভালো থাকিস

আচ্ছা যন্ত্রণা, বিয়ে ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম প্রায়। এমনিতে সবই ঠিকঠাক। সৌম্যজিত আর সৌমিলী, দুই সৌ-তে প্রেম পর্ব সেরে গুটি গুটি সংসারের সৌরজগতে ঢুকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আঠাশ আর চব্বিশ। মাহেন্দ্রক্ষণ। দু বাড়ি থেকেই বিয়ের দিন দেখা শুরু হয়েছে।

কিন্তু ওই যে। যন্ত্রণা।
পরিবারের সব্বাই শুরু করেছে। প্রথমে আত্মীয় মহল, তারপর বাবা-মা। হাল্কা হাসিঠাট্টা আর ফিসফাস দিয়ে শুরু। বর্তমানে কিঞ্চিৎ গুঞ্জনে পরিণত হয়েছে।

Saturday, August 24, 2013

গিফ্‌ট


অনিন্দ্য আর সুনন্দিতা আজকে একটু বেরিয়েছে। মাস ছয়েক বিয়ে হয়েছে। সুনন্দিতার এক দূর সম্পর্কের মাসী অনিন্দ্যদের বাড়ির কাছেই থাকেন। দুচাকায় মিনিট দশেক। অনেক দিন ধরেই যেতে বলছেন। বিয়ের পরে সিরিয়াল নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে করতে অবশেষে মাসীর পালা এসেছে।
মাসীর এক পুত্র, পুত্রবধূ, পাঁচ বছরের নাতি। এ ছাড়া আর বিশেষ কিছু অনিন্দ্যর জানা নেই। সুনন্দিতা অবশ্য মাসীকে ভালোই মনে করতে পারে, মাসতুতো দাদাকে আবছা। বৌদিকে সেই একবারই বিয়ের সময় দেখা, সুতরাং কিছুই মনে নেই।

Saturday, August 17, 2013

রঙ্গমঞ্চ


(১)
সপ্তর্ষি সকাল সকাল নার্সিং হোমে চলে এসেছেন। এবার বিদেশ থেকে ফিরেই প্রথম কাজ ছিল মাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করানো। মার পেটে অসহ্য ব্যথা, প্রথম কয়েকদিন তো যন্ত্রণায় রীতিমত ছটফট করছিলেন। এই অসময়ে দেশে ফেরার এটাই একমাত্র কারণ।

Thursday, August 8, 2013

ঘোঁতনের লাল লাটাই

দিবাকর দোলুই গল্প লেখেন। ছোটো গল্প। লিট্‌ল ম্যাগ্‌স পেরিয়ে বড়ো পত্রিকাতেও কড়া নেড়েছেন। সত্যি কথা বলতে, গল্পকারদের মধ্যে দিবাকর মোটামুটি পরিচিত নাম। এবারও পুজোসংখ্যায় গল্প লিখেছেন - গল্পের নাম হল ঘোঁতনের লাল লাটাই।

তবে লেখক দিবাকর তৃপ্ত নন, তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য হল উপন্যাস লেখা। বার কয়েক চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু সম্পাদকের দেরাজ ছেড়ে উপন্যাসের পান্ডুলিপি প্রেস অব্দি পৌছতে পারে নি। আসল কথা হচ্ছে, উপন্যাসের মত জিনিস হয় না, বেশ কেমন একটা অভিজাত অভিজাত গন্ধ। লেখা হচ্ছে তো হচ্ছেই, বনেদী বাড়ির পুজোর মত। তিন চার মাস ধরে সম্পাদকের নিয়মিত তাগাদা। হ্যাঁ, হ্যাঁ দিচ্ছি দেব করে ঝুলিয়ে রাখা। প্রতিদিন নিয়ম করে একটু সরভাজা নিয়ে রাতের দিকে বগলে বালিশ চেপে লিখতে বসা।
গল্পকারদের সেই ওজনটাই নেই। 
উপন্যাস সরভাজা হলে, ছোটোগল্প হচ্ছে আমপাচক। 

প্রকাশক দেখা হলেই বলে, "এই যে দাদা অ্যাতোগুলো টাকা অ্যাডভান্স নিলেন, কাল-পরশুর মধ্যে অন্তত লিখে দিন। লিখবেন তো ওই দেড় পাতা, তার জন্য দশবার ফোন। ধন্যি জীবন মশাই আপনাদের।" মাঝে মাঝে মনে বড়ো দুঃখ লাগে।  সেদিন এক চ্যাংড়া প্রকাশক ফোন করে বলেছে, "লজ্জা করে না আপনার? নাম তো বলেন, দিবাকর দোলুই অর্থাৎ কিনা ডিডি। কিন্তু আপনাকে তো মশাই চোখ খোলা রেখেও ভরসা করা যায় না।" 
এসব শুনে-টুনে দিবাকরের স্রেফ মরে যেতে ইচ্ছে করে। অগ্রিম না নিয়ে লেখা দিয়ে দিলে, উল্টো বিপদ। নিজেকেই টাকা আদায় করতে ঘুরতে হয়। সে আরেক যন্ত্রণা।


http://tinyurl.com/l4vsrm3

তবে আজকে তদবির নয়, আজকে একদম অন্য কাজ। দিবাকর আজ পশুপতি স্যান্যালের বাড়ি যাবেন। বালিগঞ্জের পশ কমপ্লেক্সে রাজসিক অ্যাপার্টমেন্ট। গেটের সামনে হোমড়াচোমড়া সিকিউরিটি, রীতিমত অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে হয়।
পশুপতি স্যান্যাল এই মুহূর্তে বাংলার সব থেকে বড়ো ঔপন্যাসিক। দামী দামী পত্রিকার সম্পাদকেরা ধর্ণা দিয়ে ওঁর ফ্ল্যাটে বসে থাকেন। দিবাকরের বড়ো আশা - যদি তাদের কারোর কাছে দিবাকরকে একটু রেকমেন্ড করে দেন। ব্যাগে তিনটে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আছে, দিবাকরের ঝকঝকে হাতের লেখা। পাড়ায় সুজয়ের জেরক্সের দোকানে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি কাগজে ছাপানো। পশুপতিকে পড়তে দেবেন।
পশুপতির ট্রেডমার্ক হচ্ছে উপন্যাসের রাশভারী নাম, নাম পড়লেই পাঠক অজান্তে সতর্ক হয়ে যান। এবারে যেমন নাম দিয়েছেন, পঞ্চনদীর মোহনা। 
আহা।

দিবাকরের ফের মনে পড়ে গেল, ঘোঁতনের লাল লাটাই। ছোঃ!
আজকে যা হোক একটা হিল্লে করতেই হবে।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বালিগঞ্জ চলে এসেছে। ঠিকানা খুঁজে কমপ্লেক্স বার করতে বিশেষ সময় লাগলো না। সিকিউরিটির খাতায় নাম ঠিকানা লিখে 'পারপাস' কলামটায় এসে দিবাকরের কলম থমকে গেল। মনে মনে সামান্য দুঃখের হাসি হেসে নিয়ে দিবাকর লিখলেন, 'ফ্যান'। তাঁর গড়িয়ার পলেস্তারা ওঠা বাড়ির এঁদো গলিতে, পাড়ার বাচ্চা-কাচ্চা ছাড়া কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ফ্যান কেউ কখনও এসেছে বলে মনে পড়ে না।

বিশাল ফ্ল্যাটে কলিং বেলটা টিপে দিবাকর জামার কলারটা একটু ঠিকঠাক করে নিলেন। চাকর এসে দরজা খুলে দিল। পরিচয় দিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলেন। একটু ভয় ভয় করছে। আফটার অল, পশুপতি লোকটা উপন্যাস লেখে। গলার কাছটা কেমন শুকনো লাগছে। দিবাকর অন্যমনস্কভাবে কলারটা আরেকবার ঠিক করে নিলেন।

পশুপতিবাবু এসে উল্টো দিকের সোফায় বসলেন। দিবাকর পত্রিকায় পশুপতিবাবুর ছবি দেখেছেন, সামনা-সামনি এই প্রথম।
মিনিট দশেকের মধ্যেই বোঝা গেল পশুপতি স্যান্যাল নিপাট অমায়িক ভদ্রলোক। ভয় পাওয়ার তেমন কিছু নেই। স্ত্রী-ছেলে-বৌমা-নাতি-নাতনি নিয়ে ভরাট সংসার। রাজনীতি থেকে ক্রিকেট - সব খবরই রাখেন। আরামদায়ক ফতুয়া-পাঞ্জাবী পরা বছর সত্তরের একজন লেখক। একজন সফল লেখক। দিবাকর অবশ্য কায়দা করে নিজের আসল পরিচয়টা চেপে গেছেন। পরে সময় বুঝে ফাঁস করবেন। পশুপতির উপন্যাসের অনুরাগী পাঠক - আজকের সন্ধ্যেয় এটাই আপাতত তার একমাত্র পরিচয়।

নাঃ, ফোকাস নড়ে যাচ্ছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড্‌ হওয়ার পর থেকেই দিবাকর ক্রমাগত বইপাড়া চষে গেছেন। হোমটাস্কে কোনো ঘাটতি রাখেন নি। পশুপতির কোনো উপন্যাসে নায়িকা কখন কোন রঙের শাড়ি পড়েছিল, তাও দিবাকরের পরিষ্কার মনে আছে। দিবাকর আর সময় নষ্ট না করে, পশুপতিবাবুর সবচেয়ে নামকরা উপন্যাসগুলোর প্রশংসা শুরু করলেন।
প্রশংসা শুনে পশুপতি অভ্যস্ত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ছেন। কোনো উচ্চবাচ্য নেই। মাঝে চাকর এসে চা দিয়ে গেল। পুকুরে আলোড়ন তুলতে হবে, অতএব দিবাকর প্ল্যান অফ অ্যাকশন চেঞ্জ করলেন। একটা ছোট্টো ব্যাং-লাফ মার্কা ঢিল ছুঁড়লেন, "আচ্ছা, আপনার সমকালীন গ্রাম্যতা বিষয়ক উপন্যাসগুলোতে প্রোটাগনিস্টের পদবী সর্বদা উচ্চবর্ণের কেন বলুন তো? আসলে গ্রাম্য গল্পে আনকমন পদবী হলে একটু বেশী বিশ্বাসযোগ্য হয়।"
পশুপতি বাবুর কথাটা ঠিক পছন্দ হল বলে মনে হল না।
ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, "আমাকে দেখে কি মনে হয়? এই বয়েসে গ্রাম্য পদবী খুঁজে বেড়ানো উচিত না সম্ভব?"
দিবাকর উত্তরে কি বলবেন ভেবে পেলেন না। সটান প্রসঙ্গ পাল্টে টি-২০ ক্রিকেটে চলে গেলেন।

একথা সেকথা দিয়ে প্রায় মিনিট পনেরো কেটে গেছে। এর মধ্যে পশুপতি ঠিক তিনবার ঘড়ি দেখেছেন, দু'বার রিস্টওয়াচ, একবার গ্র্যান্ড ক্লক।
এবার তো আসল কথাটা পাড়তে হয়। দিবাকর একটু উশখুশ করে, একবার সিলিঙের দিকে অকারণে তাকিয়ে, সাহস সংগ্রহ করলেন। তারপর গোটা চারেক ঢোঁক গিলে বলেই ফেললেন, "আজ্ঞে, আমি একটুআধটু লেখালিখি করি। ওই ছোট গল্প-টল্প ... আর কি। অধমের নাম দিবাকর দোলুই। আপনাকে পড়াবো বলে খান কয়েক ......"
- "কী নাম বললেন? দিবাকর?"
- "আজ্ঞে, দিবাকর দোলুই।"
পশুপতি এই প্রথম একটু নড়ে-চড়ে বসেছেন। "দিবাকর ... দোলুই ... হুঁ ... দোলুই ... বাই এনি চান্স, আপনিই কি এবার আনন্দ ভারতীতে গল্প লিখেছেন? লাল লাটাই? ঘোঁতনের লাল লাটাই?"
- "হ্যাঁ, মানে ... আমিই তো। আপনি পড়েছেন?"
- "আচ্ছা মানুষ তো আপনি, পরিচয়টা আগে দেবেন তো। এই রিমা, রিমা - অটোগ্রাফের খাতাটা নিয়ে আয় জলদি।"
দিবাকরের সব গুলিয়ে যাচ্ছে, "আজ্ঞে, মানে আমার অটোগ্রাফ চাই না। আমার শুধু কয়েকটা পাণ্ডুলিপি ......"
- "আরে দূর মশায়, সই নিতে কে বলেছে, আপনি সই দেবেন। রিমা আমার নাতনি, ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওই গল্পটা পড়ে অব্দি একটা লাল লাটাইয়ের জন্য আমাদের বাড়ি তোলপাড়। আপনি জানেন গত দু'সপ্তাহ ধরে ও আমায় দাদু না বলে ঘোঁতন বলে ডাকছে।"
দিবাকর বাকরুদ্ধ, যে কোনো সময় একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে, "আপনি সিওর? মানে আপনাকেই? ঘোঁতন বলে?"
- "আপনার কোনো ধারণা আছে, একটা সত্তর বছরের বুড়ো আর তার নয় বছরের নাতনী একটা লাল লাটাই কেনার জন্য এই পাড়ার সবকটা দোকান তোলপাড় করে ফেলছে। এই তো আজ সকালে বড়োবাজারে লোক পাঠালাম, ওই রকম সাদা-কালো রিং ওয়ালা, লাল লাটাই'ই চাই। অন্য কোনো ডিজাইন চলবে না। আপনার কলমে জাদু আছে মশাই।"
দিবাকর একটা শেষ চেষ্টা করলেন, "না, আসলে আমি মানে উপন্যাসগুলো......"
- "রাখুন তো আপনার উপন্যাস। ঘেন্না ধরে গেল। দিন নেই রাত নেই, একই চরিত্র চলছে তো চলছেই। আচ্ছা, দিবাকরবাবু, আমায় একটু শেখাবেন ছোটো গল্পের কায়দাটা? আমি না কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারি না। কুড়ি বছর ধরে উপন্যাস লিখতে লিখে এমন বদভ্যাস হয়েছে যে লিখতে গেলেই পাতার পর পাতা ভরে যায়। আমার একটা লেখাও রিমার মনে ধরে না। ওর শুধু এক প্রশ্ন - দাদু তুমি ছোটো করে লেখো না কেন?"

দিবাকর সই দিলেন। আরও এক কাপ চা খেয়ে, রিমাকে একটা রেডিমেড গল্প শোনালেন। তারপর গুডবাই বলে পশুপতির ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে, বুক ভর্তি দম নিয়ে, এক দফা শিস দিলেন।

তারপর বেরোনোর সময় সিকিউরিটির কাছ থেকে খাতাটা চেয়ে নিয়ে, 'পারপাস' কলামটা খুঁজে বার করলেন। নিজের এন্ট্রীটায় আরো দুটো শব্দ লিখলেন।  তারপর সিকিউরিটিকে মুচকি হাসি দিয়ে, গট্‌গট্‌ করে বেরিয়ে গেলেন।

সিকিউরিটি শিবু, খাতাটা উল্টে নিয়ে ভেবলে গেল।
সুন্দর হরফে লেখা আছে - 'দিবাকর দোলুই, ভিজিটিং এ ফ্যান'

Sunday, August 4, 2013

একটি সাধারণ আংটি (২)


পল্টুদা একটা সাইকেল নিয়ে এসেছে। একটা বাইক, কি নিদেন পক্ষে একটা স্কুটারও জুটলো না? আমাকে বললে তো আমার স্কুটিটা করে নিয়ে আসতাম। সাইকেলে করে শখের গোয়েন্দা এসেছে অন-কল ডিউটি করতে। প্রেস্টিজে হলুদ আর গ্যামাক্সিনের কম্বো।
সাইকেলটা গেটের বাইরে রেখেই ইশারায় আমায় ডেকে নিল।

Saturday, August 3, 2013

একটি সাধারণ আংটি (১)


ফেলুদা বিয়ে কেনো করলো না বলতো? মানে মানিকবাবুর সমস্যাটা কি ছিল? হোমস বিয়ে করে নি বলে দুনিয়ার সব গোয়েন্দা দিব্যি কেটেছে নাকি যে চিরকুমার সভায় নাম লেখাতে হবে?”, গড়গড় করে কথাগুলো উগরে দিয়ে নেভিকাটে একটা সুখটান দিলো পল্টুদা। ভালো নাম অনিমেষ বোস। আমার কলেজের সিনিয়রআমাকে হাতে ধরে রাজ্যের গোয়েন্দা গল্প ধরিয়েছে। দুবছর হল ব্যাচেলর ডিগ্রী কমপ্লিট করে সফটওয়্যার ইঞ্জিনীয়র। আমি প্রথমে ইঞ্জিনীয়ার লিখে ফেলেছিলাম দেখে একটা গাঁট্টা মেরে বল্লো, অক্সফোর্ডের ঢাউস ডিকশনরীটা কি তোর টেবিলের শোভাবর্ধনের জন্য কেনা হল বুঝি? উচ্চারণটা কি লিখেছে ভালো করে দেখে নিয়ে করেক্ট করে দে।আমিও ছাড়িনি, শুনিয়ে দিয়েছি, এই শোনো। ইংরেজী ফোনেটিক্যালি দুর্বল একটা ভাষা, বাংলার থেকে অনেক বেশী দুর্বল। বাংলা অক্ষরে ইংরেজী লিখতে গেলে বানান ওরকমই হবে।