“ফেলুদা বিয়ে কেনো করলো না বলতো? মানে মানিকবাবুর
সমস্যাটা কি ছিল? হোমস বিয়ে করে নি বলে দুনিয়ার সব
গোয়েন্দা দিব্যি কেটেছে নাকি যে চিরকুমার সভায় নাম লেখাতে হবে?”, গড়গড় করে কথাগুলো উগরে দিয়ে নেভিকাটে একটা সুখটান দিলো পল্টুদা। ভালো
নাম অনিমেষ বোস। আমার কলেজের সিনিয়র। আমাকে হাতে ধরে রাজ্যের
গোয়েন্দা গল্প ধরিয়েছে। দু’বছর হল ব্যাচেলর ডিগ্রী কমপ্লিট করে সফটওয়্যার
ইঞ্জিনীয়র। আমি প্রথমে ‘ইঞ্জিনীয়ার’
লিখে ফেলেছিলাম দেখে একটা গাঁট্টা মেরে বল্লো, “অক্সফোর্ডের ঢাউস ডিকশনরীটা কি তোর টেবিলের শোভাবর্ধনের জন্য কেনা হল বুঝি?
উচ্চারণটা কি লিখেছে ভালো করে দেখে নিয়ে করেক্ট করে দে।” আমিও ছাড়িনি, শুনিয়ে দিয়েছি, “এই শোনো। ইংরেজী ফোনেটিক্যালি দুর্বল একটা ভাষা,
বাংলার থেকে অনেক বেশী দুর্বল। বাংলা অক্ষরে ইংরেজী লিখতে গেলে
বানান ওরকম’ই হবে।”
মাঝে মধ্যেই ধরে ধরে জ্ঞান দেওয়া আর বোকামো করলে টুকটাক গাঁট্টা, ধমক। এছাড়া
পল্টুদা কিন্তু দিব্বি ভালো মানুষ। সফটওয়্যারে কাজ করছে, আর
টুকটাক গোয়েন্দাগিরি। একটা নামও ভেবে রেখেছে, “উইক-এন্ড গোয়েন্দা এজেন্সী”। ওর বক্তব্য ও এখনও এত শার্প হয়
নি যে দিনের পর দিন ছুটি নিয়ে বড়ো বড়ো কেস সল্ভ্ করতে পারবে। তার চেয়ে
টুকিটাকি কেসই ভালো। আগে পাড়ার রাস্তা, তারপর না হয় বাইপাস, তারপর নিউটাউনের সিক্স লেন। সেসব পেরিয়ে তারপর তো রাতের অন্ধকারে বোম্বে
রোড।
ওদিনটা নাকি ওর স্বপ্ন। যেদিন ও আন-পেইড লিভ নিয়ে কেস সল্ভ করবে, আর অপরাধীর কোমরে
দড়ি পড়লে ক্লায়েন্টকে গোয়েন্দাগিরির ফিজ প্লাস অফিসের কাটা যাওয়া মাইনের বিল
ধরাবে।
সেদিন পুপাই-এর জন্মদিনে পাড়ার পনেরো-ষোলো জন নিমন্ত্রিত মানুদার
বাড়িতে। মানুদা, অর্থাৎ মনোজিত ঘোষ, আমাদের পাড়ার পুরনো বাসিন্দা।
মফস্বল শহরের ছোট্টো পাড়া। আমাদের পাড়ায় এখনও ফ্ল্যাটবাড়ির থেকে বসতবাড়ি
গুনতিতে বেশী। ছোট্ট ছোট্ট একতলা বাড়ি, মধ্যে মধ্যে নারকোল
গাছ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গোনা কয়েকটা দোতলা বাড়ি।
ওদের বাড়িতে মানুদা, স্বাতী বৌদি, পুপাই আর মানুদার
মা থাকেন। মানুদার বাবা পরিতোষ ঘোষ বছর খানেক হল মারা গেছেন। তাঁর ডাকনাম ছিল
পানু। আমি পানুজ্যাঠা বলে ডাকতাম।
পানুজ্যাঠা খুব সাদাসিধে কিন্তু জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। ‘কিন্তু’ শব্দটা যোগ করতে হল, আজকাল চালিয়াতি ছাড়া
জনপ্রিয় হওয়া মুশকিল। পানুজ্যাঠা মানুষের বিপদে-আপদে নিজে থেকেই এগিয়ে যেতেন।
পাড়ার কেউ মারা গেলে শবযাত্রী জোগাড় করা, ফুটবল খেলে আছাড়
খেয়ে পা ভাঙ্গলে আম্বুলেন্স ডাকা, বেপাড়ার বেলেল্লা
বরযাত্রীকে ম্যানেজ করা - এসবে পানুজ্যাঠার জুড়ি ছিলো না। মানুষটার জীবনে একটাই
আপশোষ ছিল, বরিশালে, তার জন্মস্থানে,
যদি একবার ফিরে যাওয়া যায়। এমনিই, ঘুরতে। আমরা অনেক
বার গল্প শুনেছি, সেই সাত বছর বয়েসের পানুজ্যাঠাকে নিয়ে কি
ভাবে ওঁদের পরিবার সীমানা পেরিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন।
হঠাৎ হার্টঅ্যাটাকে চলে গেলেন, বরিশাল আর যাওয়া হল না। তো সেই পানু
জ্যাঠার ছেলে হল আমাদের মানুদা।
পুপাই এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। খুব ছটফটে পুঁচকে একটা ছেলে। ওই বয়েসের
ছেলে-মেয়ের তুলনাতেও একটু বেশীই দুরন্ত। চব্বিশ ঘন্টা পাঁই পাঁই চড়কী কাটছে। এই
যেমন আজকে জন্মদিনের স্পেশাল ঘিয়ে পাঞ্জাবী আর চুনোট করা কালচে লাল ধুতি পরে হইহই
করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কপালে নিতবরের মত টিপ। মাঝে একবার স্বাতী বৌদিকেও
পায়েস হাতে নিয়ে পেছনে ঘুরতে দেখলাম। বেশ একটা ফুরফুরে উৎসবের মেজাজ সারা বাড়ি
জুড়ে।
মানুদা হাসিমুখে অতিথির দেখাশোনা করছিলেন। আমাকে দেখেই কপট রাগে ধমকে
উঠল, “কি রে বুলু, অ্যাতোক্ষণে আসার সময় পেলি? পাড়ার মেয়ে হয়ে যদি তুই এরকম ঝোলাস, তাহলে তোর
বৌদি আমায় আস্ত রাখবে? যা যা, জলদি
ভিতরে যা। বৌদির কাছ থেকে চা’টা একটু নিয়ে নে প্লিজ।”
একটা মোটামুটি বড়ো সাইজের কেক, ক্রিকেট মাঠের আদলে। গোল, ওপরে পুরোটা সবুজ মাঠ, আর পিচটা চকোলেটের। মাঠের
ধারে খুদে খুদে প্লাস্টিকের প্লেয়ার দেখা যাচ্ছে। ইন্ডিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ।
স্কোরবোর্ড বলছে ইন্ডিয়া ব্যাট করছে, বোলার বল হাতে রান-আপে
রেডি। সাদা চিনির আম্পায়ার ডান হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেয়াররা সবাই সাদা
ড্রেস। ১৯৮৩ ফাইনাল মনে হচ্ছে। একটা প্লাস্টিকের ওয়ার্ল্ড কাপ, মেহগনি-রঙা বিস্কুট ক্লাব হাউসের পাশে রাখা আছে। কাপটা অবশ্য মাঠের
অনুপাতে বেশ বড়ো, ক্লাব হাউসের একতলা ছাড়িয়ে দোতলা
ছুঁয়েছে।
স্বাতী বৌদি ঘরে ঢুকে একটু গলা তুলে বললো, “আপনারা সবাই প্লিজ একটু বাগানে আসুন। আমাদের ড্রয়িংরুমটা মূল অনুষ্ঠানের
পক্ষে একটু ছোট। তাই আজকের সব আয়োজন ওখানেই করা হয়েছে।”
সবাই আস্তে আস্তে সদর দরজা দিয়ে বাইরের বাগানটায় এসে দাঁড়ালেন। বাগানটা বেশ
সুন্দর করে সাজানো। মরসুমী ফুল ফুটেছে। চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ,
গাঁদা – সবই আছে।
কেকের ওপরে ছ’টা মোমবাতি পোঁতা। পিচের দুধারে তিন তিন মোট ছটা
উইকেট। পুপাই কেকের কাছে মুখটা নিচু করে পিচের মাঝখানে চোখ বড়ো বড়ো করে কি একটা
করছে। জিজ্ঞেস করতে বললো, “ফুঁ দেওয়া প্রাক্টিস করছি। দাদাই বলত প্র্যাক্টিস
মেকস্ এ ম্যান পারফেক্ট। আমি তো আজ থেকে বড়ো হয়ে যাচ্ছি, বয়
থেকে ম্যান।” এখানে বলে রাখি, পানুজ্যাঠাকে
পুপাই দাদাই বলে ডাকত।
আস্তে আস্তে সবাই কফি টেবিলটার ধারে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল। মানুদা
মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল। স্বাতী বৌদি আর আমিই শুরু করলাম, হ্যাপি বার্থ ডে
টু ... ‘ইউ’তে পৌঁছনোর আগেই হঠাৎ পুপাই
দু’হাত তুলে সাবাইকে থামিয়ে থেমে থেমে, জোরে জোরে বললো, “দাদাইয়ের
আংটিটা কই? আমি ওই আংটিটা পরে ফুঁ দেব।” স্বাতী বৌদি দৃশ্যতই একটু বিড়ম্বিত।
- “পুপাই এখন জেদ করে না। কেকটা কাটা হয়ে যাক, তারপরে
তোমায় পরিয়ে দেব।”
- “না, না, না – আমার আংটিটা এখনই চাই। ফুঁ দেওয়ার সময় আমার হাতে থাকতে হবে।”
মানুদা একটু বিরক্ত।
- “কেনো রে পুপাই? তোর আংটিটা এখনই লাগবে ক্যানো?
সবাই অপেক্ষা করছে কেক কাটার জন্য।”
- “দাদাই বলেছে সব প্লেয়ারের কুসংস্কার থাকে। তুমি জানো, সচিন সব সময় বাঁ পায়ের প্যাড আর জুতো আগে পরে। কনফিডেন্স বেড়ে যায়।
দাদাই বলেছিল, ওই আংটিটা পড়লে আমি কক্ষণও কিচ্ছুতে ফেল করব
না। কেকে ফুঁ দেওয়ার আগে আমার ওই আংটিটাই চাই।”
এর পরে আর কথা চলে না। মানুদা স্বাতী বৌদিকে চোখের ইশারায় আংটিটা আনতে
বলে সবার দিকে তাকিয়ে একটু সময় চাওয়ার মত মুখ করলো। অবশ্য পুপাইএর যুক্তির
বহর শুনে ততক্ষনে সবাই এমনিতেই বেশ কনভিন্সড্। এক ফুঁতে মোমগুলো নেভাতে যে আংটিটা
দরকার এটা নিয়ে আর বিশেষ আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না।
স্বাতী বৌদি দ্রুত পায়ে ভিতরের ঘরে চলে গেল। পুপাইের বন্ধুরা নিজেদের
মধ্যে আবার খুনসুটি আরম্ভ করেছে। বাবাই, পাশের বাড়ির ছোট্টো ছেলেটা। সে তো পুপাই
দাদা বলতে অজ্ঞান। পুপাইের থেকে বছরখানেকের ছোটো, কিন্তু
পুপাই ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের সব খবর রাখ বলে এই আনুগত্য। বাবাই মানুদার পায়জামা
ধরে টানছে, “পুপাই দাদা, কেকটা কেটে প্রথমে আমাকে দেবে তো?”
হঠাৎ স্বাতী বৌদির গলায় চাপা চিৎকার। স্বাতী বৌদি তো শান্ত মানুষ।
হঠাৎ রাগারাগি করার লোকই না। মানুদা একটু অপ্রস্তুত মুখে
বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। অতিথিদের মৃদু গুঞ্জন থেমে গেছে। বড়োদের মুখে একটু থতমত
ভাব। দু-তিন মিনিট কেটে গেল। কয়েকজন
অতিথি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছেন। এবার তো একটু খোঁজ নিতে হয়।
সবাইকে বললাম, “আপনারা একটু ধৈর্য
ধরুন। আমি এক্ষুনি দেখে আসছি।”
ড্রয়িং রুমের পাশের প্যাসেজটা দিয়ে একটু এগোলেই মানুদার বেডরুম।
সেখান থেকেই আওয়াজ আসছে। দরজার সামনে গিয়ে একবার খক খক করে কাশির আওয়াজ করতে
মানুদা বেরিয়ে এল। “বুলু দেখতো কি মুশকিল।” ঘরে ঢুকে দেখি, স্বাতী বৌদি ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে। হাতে সেনকো গোল্ডের একটা লাল
ভেলভেটের খোলা বাক্স। ভেতরটা ফাঁকা। আংটি নেই।
মানুদা বলল, “কি করি বলতো বুলু? সোনার নয়। ফাঁকা গয়নার বাক্সে রাখা ছিল। এমনিতে দামী কিছু নয়, কিন্তু বাবা নিজে হাতে করে কিনে দিয়েছিলেন।”
আমার মাথায় প্রথমেই যেটা এল সেটা হচ্ছে, পল্টুদার মোবাইল নাম্বার। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আমি ফোন করলাম।
- “কি রে, ডেটাবেস আটকেছে, না অ্যালগোরিদ্ম?”
রোবাবারের আয়েসী গলা ভেসে এলো ফোনের ওপার থেকে। আমি একটু হেঁ হেঁ করে ডেটাবেস প্রোগ্রামিং এর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলাম। প্রোগ্রামগুলো না লিখে অন্যের জন্মদিনে হুল্লোড় করছি শুনলে প্রচুর ক্ষেপে যাবে।
- “গোয়েন্দাগিরি করবে?”
- “ইয়ার্কি মারিস না। ভরদুপুর বেলায় ফোন করে আর কথা পেলি না?”
- “তোমার জন্য একটা কেস পেয়েছি। জলদি চলে এসো। আমাদের বাড়ির তিনটে বাড়ি পরে হলুদ দোতলা বাড়ি।”
- “সিরিয়াস?”
- “হ্যাঁ, সিরিয়াস। আংটি হারিয়ে গেছে। বাচ্চা ছেলের আংটি। ঘর ভর্তি লোক, জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেতে এসেছে।”
- “আচ্ছা ... দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। লোকজনকে একটু সামলে রাখিস, কে কে বাড়িতে ঢুকছে-বেরোচ্ছে খেয়াল রাখিস।”
মোবাইল পকেটে পুরে স্বাতী বৌদিকে নিয়ে পড়লাম। “অ্যাতো অতিথি এসেছে, তুমি পুপাইকে বাইরে নিয়ে যাও। স্বাভাবিক কথা-বার্তা বল। আংটির ব্যাপারটা এক্ষুনি কাউকে বলার দরকার নেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বল, রান্নাঘরে গরম জল উলটে গেস্ল। চা-কফি দিয়ে দশটা মিনিট আটকে রাখো। আমার একটা সিনিয়র দাদাকে আসতে বললাম। যদি ও খুঁজে বার করতে পারে।”
- “তোর সিনিয়র? সে খুঁজে দেবে? পার্ট-টাইম গোয়েন্দা নাকি?”
- “ওই আর কি, প্রচুর গপ্পের বই পড়ে তো। মাথায় প্রচুর আইডিয়া ঘোরে। যদি কিছু করতে পারে।”
bhalo-i likhchhis to. taa - tor goyenda ki bibahito ?
ReplyDeleteKromosho prokashyo :)
DeleteTarpor?
ReplyDeleteAsitechhe asitechhe :)
Deletebesh bere hoyeche to..amaro goyenda goppo byapok lage..kintu bakita koi????? :)
ReplyDeleteOdyo boikal char ghotikay prokashito hoibek ..
DeleteAnirban-babu, apnar golpo porte asechi "abantor" e apnar bigyapon dakhe. Eshe dekhlam apni goppo besh jomiye felachen. Chaliye jaan. Suspense jome utheche.
ReplyDeletechup-kothat swagotom ghonada ..
Deletethik jaygatei ad diyechhi tahole, ki bolun? e goppo onek din age lekha - baki angshota ekhane - http://chup-kotha.blogspot.in/2013/08/blog-post.html