(১)
সপ্তর্ষি সকাল সকাল নার্সিং
হোমে চলে এসেছেন। এবার বিদেশ থেকে ফিরেই প্রথম কাজ ছিল মাকে
নার্সিং হোমে ভর্তি করানো। মার পেটে অসহ্য ব্যথা, প্রথম
কয়েকদিন তো যন্ত্রণায় রীতিমত ছটফট করছিলেন। এই অসময়ে দেশে ফেরার এটাই একমাত্র কারণ।
মা গত চার দিন ধরে ভর্তি। সপ্তর্ষি
খরচার পরোয়া করেন নি, সিঙ্গল কেবিন নিয়েছেন। পার্সোনাল আয়া। নাম সুস্মিতা। গতকাল ব্লাড
টেস্ট করানোর জন্য সুস্মিতা মাকে প্যাথোলজী ডিপার্টমেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। আজকে রিপোর্ট কালেক্ট করার কথা। সপ্তর্ষি হেমাটোলজি সেকশনে
গিয়ে দেখলেন কেউ নেই। নিশ্চয়ই সব একসাথে চা খেতে গেছে, কিম্বা টি-টোয়েন্টি দেখছে। পশ্চিমবাংলার
এই একটাই সমস্যা। এখানে বেশীরভাগ মানুষ নিজের দায়িত্ব বোঝার আগেই নিজের দাবি বুঝে
যায়।
“কেউ আছেন দাদা?”,
বলতেই চাপা প্যান্ট পরা লিকলিকে একজন ভেতরের ঘর থেকে উঁকি দিলেন, “কি
চাই?”
দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে সপ্তর্ষির
ওয়ার্ক কালচার আলাদা। কাজে অবহেলা একদম সহ্য করতে পারেন না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে
লোকটির মুখের দিকে তাকালেন।
স্মৃতি এক ধাক্কায় তিরিশ বছর
পিছিয়ে গেল। আচ্ছা, এই কি সেই স্বর্ণেন্দু?
ক্লাস ফোরের দুটি ছাত্র।
স্বর্ণেন্দু আর সপ্তর্ষি। দুটো টিফিন, একটা দশ মিনিটের, পরেরটা
কুড়ি মিনিটের। প্রথম টিফিনটা তাদের খরচ হয়, কল্পিত স্ক্রিপ্ট
লিখতে, কে কোন দেশের রাজা হবে। ঠিক কতটা আস্ফালনের পরে নারকোল পাতার
মাঝের শিরারূপী তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধটা শুরু হবে। কোনদিন কে হারবে, কবে যুদ্ধ ড্র
হবে।
বড়ো টিফিনের ঘন্টাটায় টেনে
ছুট। বেশীরভাগ ছেলে-পুলে মাঠে খেলছে - ক্রিকেট, ডাঙ্গুলি, লুকোচুরি। এরা দু’জনে
চলে যায় নতুন বিল্ডিং আর পুরোনো বিল্ডিং যেখানে মিলেছে, তার
পিছনে। বাউন্ডারী দেওয়ালের ঠিক পাশে একটা আট-ফুট-বাই-আট-ফুট খোঁদল মতো হয়ে রয়েছে।
বাড়ির প্ল্যানিং ঠিকঠাক হয় নি। তিন দিকে দেওয়াল, আর সামনে একটা
বিশাল অশোক গাছ। তার পাশে একটা নাগকেশর। সব সময় ছায়ায় ঢাকা, অন্ধকার একটা জায়গা। এদিকে
কেউ খুব একটা আসে না। হেড স্যার যুদ্ধ করতে দেখতে পেলে বকবেন বলে এই গোপন ব্যবস্থা। স্বর্ণেন্দু
আর সপ্তর্ষি অবশ্য কোনোদিন ঠিক ঠাহর করতে পারে নি কেন তাদের এখানেই অভিনয় করতে
ভালো লাগে। তাদের সেই বয়েসে বোঝার কথাও নয়। অবচেতনে ঠিক যেন
একটা ঘেরা রঙ্গমঞ্চ,
গাছগুলো দর্শক।
স্বর্ণেন্দুর একটা অভ্যেস
ছিল, স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে অতিনাটকীয় ডায়লগ বলা। একবার সপ্তর্ষি পুরু হয়েছে,
বন্দী অবস্থায় দাঁড়িয়ে। নারকোল দড়ি দিয়ে হাত বাঁধা। স্বর্ণেন্দু আলেকজান্ডার। বেল্টের
ঘর থেকে তরবারী বার করে অম্লান বদলে বলল, “আলেকজান্ডার
কাপুরুষ নয় রাজন্। সে বীরের সম্মান দিতে জানে। খোকনদা, মহারাজ পুরুকে অবিলম্বে একটু
পুরু করে মাখন লাগিয়ে স্পেশাল টোস্ট বানিয়ে দাও।”
খোকনদা অবশ্য নাট্যমঞ্চে
উপস্থিত ছিল না। অনেক অদৃশ্য চরিত্রের একজন। আহ্, সেই সবুজ গেটের পাশে খোকনদার
দোকান। এখনো আছে কি না কে জানে।
![]() |
http://tinyurl.com/l64lft8 |
“কি হলটা কি? হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বেড নাম্বারটা বলুন, ব্লাড রিপোর্টটা খুঁজে আনি।” সপ্তর্ষি বাস্তবে ফিরে এলেন। একবার সরাসরি তাকালেন ভদ্রলোকের দিকে। বেড নাম্বার বললেন। তারপর একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করি, আপনিই কি স্বর্ণেন্দু, পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন ১৯৯০ ব্যাচ? তারপর মত চেঞ্জ করলেন। থাক, ব্লাডটেস্ট হয়ে যাক, তারপর। রিপোর্টে বোধহয় নাম লেখা থাকবে, তখন দেখে নেবেন।
সপ্তর্ষি নার্সিংহোমের বাইরে
এসে একটা সিগারেট ধরালেন। এক ঝটকায় অনেক কিছু মনে পড়ে গেছে। একবার দুই বন্ধু মিলে
বড়দের নাটক দেখতে গেছিল। সীতার বনবাস। বয়েজ স্কুল, তাই সীতার পার্ট করেছিল
ধীরেনদা। টিফিনের সময় পেতলের ঘন্টা বাজাতো, সেই ধীরেনদা। লাল শাড়ি পরে ধীরেনদার কি
চমৎকার অভিনয়। ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে ড্রেসিংরুমে খুঁজতে গেছিল। ঘোমটা খুলে ধীরেনদা
বিড়ি ফুঁকছে দেখে পালিয়ে এসেছিল।
তখন ক্লাস ফোর তো, স্কুলের
নিয়মে তারা তখনও পেন্সিল। ক্লাস ফাইভে উঠলে তবে ফাউন্টেন পেন। মাত্র এক বছরের
অপেক্ষা কিন্তু ক্লাস ফাইভ যেন দূরের কোনো গ্রহ। পরীক্ষার সময় সিট পড়ে, একটা
বেঞ্চে তিনজন। দু’পাশে ক্লাস ফাইভ, মাঝে ক্লাস ফোর।
তিন ঘন্টার পরীক্ষা আড়াই ঘন্টায় শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে পইপই করে মা বলে দিয়েছেন, রিভিশন
করতে, কিন্তু সপ্তর্ষি চোখ সামলাতে পারে না। অলস পল্লবগ্রাহীতার
ফাঁকে বারবার চোখ চলে যায় দাদাদের খাতার দিকে। কি সুন্দর ঝরণার মত লেখা, পেন্সিলের
লেখাতে সেই গ্ল্যামারটাই নেই। নেভি ব্লু ক্যামেল কালি দিয়ে লেখা অক্ষরগুলো যেন
ছাপার অক্ষরের মত স্পষ্ট।
রাস্তায় একটা গাড়ির বিশ্রী
হর্ণে চটকা ভেঙ্গে গেল। নাহ্, এবার একবার ডাক্তার বাবুর সাথে দেখা করতেই হবে।
এদের এখানে নিয়মটা কি? রুগির রিপোর্ট সরাসরি ডাক্তারের কাছে যায়, নাকি তাকেই বয়ে
নিয়ে যেতে হবে? ধুস্, হোপলেস দেশ। মিনিমাম লেভেলের হেলথকেয়ার কি ভাবে দিতে হয়
সেটাও এখানে কেউ জানে না। সপ্তর্ষি সিগারেট ফেলে দিয়ে নার্সিংহোমে ঢুকলেন।
(২)
ভাগ্যক্রমে ডাক্তারবাবু
পেশেন্ট কেবিনের দিকেই যাচ্ছিলেন, দেখা হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু সপ্তর্ষির সাথে দ্রুত
কথা বলে নিয়ে লিফ্টের দিকে পা বাড়ালেন।
রিপোর্ট নিয়ে সেই লিকলিকে ভদ্রলোক।
পেশেন্ট কেবিনে চলে এসেছেন। মার সাথে কথা বলছেন।
- “দেখ
না বাবু, রাজু কি বলছে? ও তোকে বলা হয় নি, ওর নাম রাজু। আমার সব কটা
ব্লাড টেস্ট ওই করেছে। সত্যিই কি আমার রেসিপি অ্যাতো ভালো? তুই’ই তো সব চেয়ে ভালো বলতে পারবি। আচ্ছা শোন, তুই কিন্তু এয়ার টিকিটটা কনফার্ম করে দিস।
ভাবছিলাম এবার বুঝি আর যাওয়া হল না। ভগবান শুনেছেন।”
ভদ্রলোক হাসিমুখে সপ্তর্ষির
দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডাক্তার বাবুর সাথে দেখা করে এসেছেন তো?
মাসীমা আপনার চিন্তায় অস্থির।”
সপ্তর্ষি একটু যেন ক্লান্ত, “হ্যাঁ,
মানে ... এই তো ... করিডরে দেখা হল। ধন্যবাদ। মাকে আপনারা এত দেখে রেখেছেন। মা ...
আজ মনে হয় অনেকক্ষণ থাকতে হবে। আমি বরং একটু কিছু মুখে দিয়ে আসি।”
রাজু ঝাঁপিয়ে পড়লেন, “কি
যে বলেন? বাইরে খাবেন? আজকে সন্ধ্যেবেলা বাইরে থেকে
মুড়ি-বাদাম-ছোলা-কুঁচোনো-আদা-পেঁয়াজ-নারকোল স্মাগ্ল করে আনা হচ্ছে। মাসীমার
প্ল্যান। মাসীমার ট্রিটমেন্ট ভালো এগোচ্ছে, তাই আমাদের দিক থেকে ট্রিট।”
- “সে
কি মা তুমি এসব বল নি তো? তোমার তো কমপ্লিট বেডরেস্টে থাকার কথা। তা ছাড়া খাওয়াদাওয়ার
রেস্ট্রিকশন......”
- “না
রে, আমি তো শুধু মুড়িই খাবো। শুধু সুস্মিতা আর রাজুর জন্য একটু ভালো করে মেখে দেব।”
সপ্তর্ষি হতবাক, “তুমি
নার্সিংহোমে মুড়ি মাখবে?”
ছেলের বকুনি খাওয়া মাসীমার মুখ দেখে রাজুই এগিয়ে এল, “শুধু তাই? আপনি
জানেন মাসীমা কত লাকি? গত পরশু টি-২০ ম্যাচটায় আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কন্ট্রোল
রুমে টিভি অফ করে দিয়েছিল সবাই। মাসীমাকে টিফিন দিতে এসে সুস্মিতা টিভির চ্যানেল
ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। মাসীমাই ধৈর্য ধরতে বললেন। ব্যস্। ম্যাজিকটা হল। কোথাকার কে রবীন্দ্র জাদেজা, তার
একটা ওভারে তিন-তিনটে উইকেট। ডাক্তার বাবু অব্দি ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে কেবিন ছেড়ে
বেরোতে পারলেন না।”
সপ্তর্ষি লক্ষ্য করলেন, মা
যেন অল্প অল্প লজ্জা পাচ্ছেন। প্রশংসাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।
- “আচ্ছা,
ডাক্তারবাবু কি বললেন রে? কবে তোর সাথে ওদেশে যাবো? তোর ছুটি তো ফুরিয়ে এল।”
সপ্তর্ষি মুখ খোলার আগেই আবার রাজু
মুখ খুললেন, “মাসিমা, আপনাকে তো বললাম। গ্যারান্টী দিচ্ছি এ বছরও আপনি ছেলের
সাথে যেতে পারবেন। আপনি লিখে নিন। আর তিনদিনের মধ্যেই আপনি সেরে উঠছেন। শুধু
যাওয়ার সময় বোম্বের কানেক্টিং ফ্লাইট নিয়ে নেবেন। তেমন কিছু না, ওখানের বড়ো
ডাক্তারকে একবার দেখিয়ে নিতে হবে, ব্যস্।”
মা কেমন হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ব্লাড টেস্টের জন্য সকাল থেকে উপোসে থাকার চিহ্ন মাত্র নেই। এদিকে ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, “জানেন মাসীমা, আপনাকে হয়ত আজকেই ছেড়ে দিত। কিন্তু দুএকটা টেস্ট এখনও বাকি আছে। সেটা করে নিয়ে কালকেই বোধহয় ছেড়ে দেবেন ডাক্তারবাবু। একদিক দিয়ে ভালোই হল, মেট্রনের কাছে বলছিলাম আপনার স্পেশাল মুড়িঘণ্ট রেসিপি’টা। নার্সিংহোম থেকে চলে যাওয়ার সময় আরো দুএকটা ওরকম শিখিয়ে যাবেন। আপনাকে বলছি, আর কাউকে বলবেন না। হাসপাতালের ডাল ভাত চচ্চড়ি খেতে খেতে একদম মুখ মেরে গেছে।
আর, চকোলেটের ব্যাপারটা মনে রাখবেন কিন্তু।”
মা অল্প হেসে মাথা নাড়লেন। সপ্তর্ষি একটু খেই হারিয়ে
ফেলেছেন, “চকোলেট?”
- “হ্যাঁ
রে, ওদের কথা দিয়েছি, এবার তোর ওখান থেকে ফেরার সময়, ওদের জন্য একটু ফ্রুট চকোলেট নিয়ে আসব।”
মা কিরকম শিশুর মত হাসছে। সপ্তর্ষি
খুব মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করলেন, শেষ কবে মাকে এতটা খুশী দেখেছেন।
রাজু হেসে সপ্তর্ষির দিকে
ঘুরে দাঁড়ালেন, “নাহ্ অনেক দেরী হয়ে গেল। মাসীমার ঘরে এলেই ...... যাক, আপনারা
মায়ে-ছেলেতে বসে গপ্পো করুন তাহলে। আমি চল্লুম। এই নিন ব্লাড রিপোর্ট।”
সপ্তর্ষি হাত বাড়িয়ে রিপোর্টটা
নিলেন।
রিপোর্ট খোলার প্রয়োজন নেই। ডাক্তার
চৌধুরী লিফ্টে ওঠার আগে বললেন, লিউকোমিয়া। ব্লাড ক্যান্সার ফাইনাল ষ্টেজ। ম্যাক্সিমাম
আর দু-তিন মাস,
বেশ কষ্টকর কাটবে মায়ের শেষের দিনগুলো। এই যন্ত্রণাটা মা না
পেলেই হত বোধহয়। ডাক্তার চৌধুরী বলেছেন, কেমোথেরাপী করে শরীরটাকে আর কষ্ট না দিয়ে শেষ
কটা দিন যাতে মাকে খুশী করে রাখা যায়। আর শরীরে দিলে বোম্বের টাটা ক্যান্সার
রিসার্চে একবার যদি ...।
আর হ্যাঁ, সপ্তর্ষির বিন্দুমাত্র
সন্দেহ নেই।
রাজু চিনতে না পারলেও, সপ্তর্ষি রাজুর পরিচয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ক্লাস ফোরের
সেই খুদে অভিনেতাকে চিনতে এখন আর একটুও অসুবিধে হচ্ছে না।
শুধু রঙ্গমঞ্চটা পাল্টে গেছে। আজ সপ্তর্ষি শুধুই দর্শক।
শুধু রঙ্গমঞ্চটা পাল্টে গেছে। আজ সপ্তর্ষি শুধুই দর্শক।
khub bhalo laglo ....
ReplyDeletemonta kharap hoye gelo pore
ReplyDeleteFantastic roshni .. Chhoto golpo likhe mon ta ke naranoi lokhyo ..
Deleteঅনবদ্য । অনেক দিন পর কোনও গল্প পড়ে এত ভাল লাগল । পরেরটার জন্য মুখিয়ে রইলাম।
ReplyDeleteআচ্ছা, দেখা যাক।
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteAshadharon boss ! Chaliye jao....
ReplyDeleteতোর কমেন্ট পরে মনে হচ্ছে একটা রেগুলার পাঠক ধরেছি। পাঠক ধরা টা খুব ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার আর কি :-)
Deleteপড়ে *
DeleteSotty re.. rongomoncho ta ak.e thake.. sudhu golpo gulo change hoye jai...
ReplyDeleteসেটাই দেখছি, বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে।
DeletePore besh bhalo laglo, kintu Sita-r bonobas natoke Draupadi keno bhujte parlam na...
ReplyDeletehe he, delhechen apni i prothom golta ta dhorlen sandip. thik kore debo nischoi.
DeletePore boro valo lagche...tui chalie ja....
ReplyDeleteসওয়ারীর নাম জানতে পারলে আরো জমত বোধহয়। ইতি, চালক।
Delete