Friday, February 15, 2019

না-মুমকিন (১)

ডিপ্রেশন দেশটাকে ছিঁড়ে ফেলছে। লোকে রেশনের দোকানে লাইন দিয়ে ফুড কুপন তুলছে। দলে দলে মানুষ রাস্তায় হাঁটছে, বিক্ষোভ সবে দানা বাঁধছে। গ্রেট ডিপ্রেশনের শুরু। তারই মধ্যে মিছিল থেকে চোখ সরিয়ে একটা বছর কুড়ির ছেলে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে সিগাল পাখি দেখছে। ভ্রু-কুঞ্চিত।

থার্ড টেস্টে ৯৬ রানে নট আউট। মেলবোর্ন মাঠটা বেশ বড়। বলটা ঠেলেই বুঝতে পেরেছিল যে বাউন্ডারি নাও হতে পারে। দে দৌড়। চারটে রান দৌড়ে নিয়ে ব্যাট তুলেছিল। সে সুখস্মৃতি স্থায়ী হয় নি। ম্যাচ আর সিরিজ দুটোই তো হেরে গেল অস্ট্রেলিয়া। বেমক্কা নয়, হারার'ই ছিল। বুড়ো প্লেয়ারদের বাতি নিভে এসেছে। হেনরি, কিপ্যাক্স, কেলওয়ে, রাইডার, ব্লেকি - সব চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে। নড়তে চড়তেই সময় চলে যাচ্ছে। বোলারদের বলে না আছে কামড়, আর ব্যাটিং আর ফিল্ডিঙে দৌড়ের নমুনা নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। তাই এবারে নির্বাচকেরা জ্যাক্সন আর ব্রাডম্যান বলে দুজনকে টিমে নিয়েছেন, কুড়ি আর উনিশ। মানে এদের মিলিত বয়েস ওই আগের লিস্টের প্রত্যেকের থেকে কম।

এক হ্যাঁচকা টানে বর্তমানে ফিরে এল ছেলেটা। আজকে ৫ই মার্চ, ১৯২৯। তিনদিন বাদে ফাইনাল টেস্ট শুরু। ফিফথ টেস্ট অব অ্যাসেজ। আবার মেলবোর্নেই পড়েছে। ছেলেটা মোটামুটি নিশ্চিত টিমে থাকছে। কিন্তু তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। যে ভাবেই হোক, একটা চাকরি জোটাতে হবে। টেস্ট ক্রিকেট খেলে তো ভাই পেট চলবে না। বাউরালে জেসি অপেক্ষা করছে। ইচ্ছে ছিল, কুড়িতে পা দেওয়ার আগেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলবে। কিন্তু পাকাপাকি একটা রোজগারের ব্যবস্থা না হলে তো সেসব প্রগলভতা মাত্র।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠল সে। মাইক সিমন্স কোম্পানির ম্যানেজার অস্কার লসন স্কুলবয়দের কোচিং করার একটা চাকরি জোগাড় করে দেবেন বলেছেন। তাতে কোম্পানির নাকি পি আর হবে। দেখা যাক।

মনটা সামান্য বিক্ষিপ্ত। অনেক কষ্টে যদিও বা টেস্টের দরজা খুলল, প্রথম সিরিজেই ফোর-নিল পিছিয়ে, কোনো মানে হয়? সারা দেশ হা পিত্যেশ করে তাকিয়ে আছে এই খেলাটার দিকে। খেলা তো নয়, আসলে এককালের মনিবের হাত থেকে ট্রফি ছিনিয়ে নেওয়া। সত্যি, থাকিস তো ওই পুঁচকে একটা দেশে। শুধু ব্রিটেন বললেই চলে যেত। তা নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে গ্রেট ব্রিটেন আর তার কলোনি। সব দেশ থেকে তাদের ধনসম্পত্তি লুঠ করেই বাছাধনেরা দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছিল, এখনও যাচ্ছে। ১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়া স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিল। শোনা যাচ্ছে এখন নাকি ব্যাটাদের সব মৌজ-মস্তি ভারতবর্ষ বলে একটা দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে হয়।
এবারের ভিজিটিং ইংলিশ টিমের সাথে পার্সি ফেন্ডার বলে একটা ব্রিটিশ এসেছে - হাড় জ্বালানে লোক একটা। আগে ক্রিকেট খেলত – হাসির খোরাক - ব্যাটিং অ্যাভারেজ কুড়ির নিচে, বোলিং চল্লিশের ওপরে। যাজ্ঞে, নির্বাচকরা এবার আর খেলাতে সাহস করে নি। তাও এত সখ, স্রেফ ক্রিকেট নিয়ে লিখবে বলে অস্ট্রেলিয়া চলে এসেছে। কিন্তু স্বভাব কি আর হাত থেকে ব্যাট নামিয়ে রাখলে চলে যায়। ওর নাকি ট্রেনে টুথপেস্ট ফুরিয়ে গেছিল, তো সহযাত্রীকে ভজিয়ে, ব্রিসবেন থেকে তিনহাজার কিলোমিটার দূরের একটা ছোট গ্রামের স্টেশনে সহযাত্রীকে নামিয়ে তার সাথে পাক্কা কুড়ি মিনিট বাবু হেঁটেছেন। তো সে হেঁটেছেন তো বেশ করেছেন, এ তো আর লন্ডন নয় রে বাবা যে মোড়ে মোড়ে  টুথপেস্টের দোকান থাকবে। গ্রামের সেই দোকান পাওয়াও গেছিল, কিন্তু দরজা জানলা সব বন্ধ। দুপুর হতে চলল কিন্তু দোকান খোলে নি, তাই একটু রেগে দরজা ধাক্কাতে গিয়ে ছোট্ট চিরকুটটা চোখে পড়ল। "Closed. Gone to the Test” - দোকান বন্ধ থাকিবে, খেলা দেখিতে যাইতাছি। ফেন্ডার তো রেগে কাঁই – দোকানিটা পাগল ছাগল নাকি? তিনহাজার কিলোমিটার দূরে ক্রিকেট দেখতে গেছে।

ফেন্ডারকে বোঝাবে কে? সে তো এসেছে গ্রেট ব্রিটেন থেকে - যে দেশের প্রস্থ সাকুল্যে চারশো সাইত্রিশ কিলোমিটার।

ইংরেজ ক্রিকেটারদেরও তথৈবচ অবস্থা। বেড়াতে বেড়িয়েছিল। ট্রেন লাইনের পাশে কাঠের স্লিপার দিয়ে পিচ বানিয়ে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলছিল। ছেঁড়া বল আর চ্যালা কাঠের ব্যাট দেখে ভারি আমোদ হয়েছিল সায়েবদের। তাই দাঁড়িয়ে পড়ে খেলা দেখছিল সবাই। এমনিই প্র্যাক্টিস করছিল ওরা। সাত-আটটা ছেলে, দুটো টিমে ভাগ করাই মুশকিল। ইচ্ছে হয়েছে, ব্যাটবল খেলছে। হঠাৎ দর্শকদের খেয়াল করে তারা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একটা লম্বা ছোকরা এসে বলল, "ক্রিকেট খেলবে? ব্যাটবল আমাদের, তাই আমরা অস্ট্রেলিয়া হব, তোমরা ইংল্যান্ড কিন্তু”।
ইয়ার্কির একটা সীমা থাকা উচিত।

অবশ্য ব্রিটিশদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, নিজেদের দিকটাও দেখতে হবে। ফার্স্ট টেস্টের সেকেন্ড ইনিংসে ৬৬ রানে বান্ডিল। তার মধ্যে উডফুল ওপেন করতে নেমে তিরিশ, আসল হিসেবে নটা উইকেট ছত্রিশ রানে পড়েছে। ব্র্যাডম্যান মোটে এক। জীবনের প্রথম টেস্টের সেই হতাশা মাখা ড্রেসিংরুম সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। ড্রেসিংরুম থেকে কোনওরকমে শরীরটা টেনে বার করে নিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল, কেলওয়ে রিপোর্টারকে বাইট দিচ্ছে - কথা হচ্ছে ব্র্যাডম্যান ছোকরার টেস্ট ভবিষ্যৎ নিয়ে। ব্যাটা বুড়ো ভাম বলে কিনা, “Bradman is not up to test standard”. হয়তো সত্যিই তাই, পরের টেস্টে তো বসিয়েই দিলেন নির্বাচকরা।

No comments:

Post a Comment