Wednesday, December 14, 2022

দেশে বিদেশে ফুটবল

 (১) পাওলো আর অ্যামান্ডার গল্প




মাস্টার ডিগ্রী চলাকালীন একটি ব্রাজিলের ছেলে, নাম পাওলো, আমাদের সাথে পড়ত। সুইজারল্যান্ড পাহাড়ি জায়গা, বড় মাঠের অভাব। তাই ছোট জাল ঘেরা টার্ফে খেলা হত। টার্ফের বাইরে বরফ। এবার ঐটুকু জায়গাতেই পাওলোর পায়ে ব্যানানা শটের ফুলঝুরি। পরিষ্কার দেখছি বলটা বাইরে যাচ্ছিল, কীরকম বেঁকে ঢুকে গ্যালো। ফ্লুক নয়, বারংবার। বা ধরুন, এই আপনার সামনে পাওলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পায়ে বল। চোখের পলক ফেলার আগেই পায়ে বল নেই। পাওলো খালি দাঁড়িয়ে। বল কই? আপনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কী হয়েছে, জাস্ট আপনার মাথা টপকে ফুটবল'খানা আপনার পেছনে চলে গেছে। আর পরের মুহূর্তে পাওলো আপনার পেছনে গিয়ে বলের দখল নিয়ে ভাগলবা। মানে ম্যাজিক দেখে হাঁ মুখ বন্ধ হওয়ার আগেই পাওলো হাওয়া। ১৮০ ডিগ্রি ঘোরা ছাড়া আপনি আর বিশেষ কিছু করতে পারেন নি।
সহপাঠীদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ চলার সময় পাওলোর টিম বরাবর ঐ ১০-২ বা ৮-১ এইরকম স্কোরে জিতত।তাই বলে তো আর তাকে বলা যায় না ভাই আর খেলো না। হাজার হোক, সে তো আমাদের বয়েসী একটা ছেলে। শেষ অব্দি একজন সুইস সেকেন্ড ডিভিশনের কোচ ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের টিমে খেলাবেন বলে। পাওলো দেখলো ভালোই হবে--- প্রফেশনাল লেভেল খেলা যাবে, পয়সাও পাওয়া যাবে। অড জব করতে হবে না।
পাওলো তো চলে গ্যালো। তার জায়গায় আমাদের এক সহপাঠিনী--- সেও ব্রাজিলের, খুব জেদ করল আমাকেও খেলায় নাও। বাকী মেয়েরা কেউ খেলে না ফুটবল। তাই অ্যামান্ডার খেলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু যাই হোক। ফুটবল বডি কন্ট্যাক্ট গেম। ছেলে মেয়ে একসাথে খেলবে? ধাক্কা লেগে পড়ে যাবে না? কিন্তু অ্যামান্ডার অখন্ড জেদ। আচ্ছা তাহলে তাই হোক। ফাইভ এ সাইড খেলা। ৯ টি ছেলে, ১ টি মেয়ে।
আমরা ৯ জন আলাদা করে আলোচনা করে নিলাম যে অ্যামান্ডাকে কড়া ট্যাকল, থ্রো বা পেনাল্টির পাওয়ার জন্য দেহ লক্ষ্য করে জোরে শট নেওয়া ইত্যাদি করা হবে না। সাদা বাংলায় যাকে বলে দুধে-ভাতে। আউট করা যাবে না।
এর পরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত। মাঝমাঠ থেকে তোলা বল মেয়েটি বুকে রিসিভ করল। বল বুকে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পরার আগেই পেলব শট। হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা গোলকীপার পেরিয়ে অন্য দিকের পোস্টের পাশ দিয়ে জালে গড়িয়ে গেল।

মেয়েটির নাম ছিলো অ্যামান্ডা। সে আমায় পরে বলেছিল, ফুটবল সে খুব একটা ভালো খেলতে পারে না। ম্যারাথন দৌড় বেশী প্রিয়। পাড়ায় সবাই ফুটবল খেলে জন্ম থেকে। তাই দেখে অ্যামান্ডা'ও অল্পস্বল্প শিখেছে। 

--

(২) ফুটবুলের যুদ্ধ না যুদ্ধের ফুটবল?



আজকে ইরানের খেলা দেখতে দেখতে মনে পড়ে গ্যালো নাইমেঘেন শহরে আমার চিলেকোঠার ভাড়া ঘরের কথা। বাড়ির মালিক ইতালিয়ান। আর সেখানে তিন ঘর ভাড়াটে — বুল্গেরিয়ান, ইরাকী আর ভারতীয়। ইরাকী ছেলেটির নাম ভুলে গেছি। ২০০৮ সালের কথা। তাই পুরনো সবুজ ডায়েরীটা ধুলো ঝেড়ে বার করলাম। বাকীটা সেখান থেকেই টাইপ করে লেখা। ২৩ নভেম্বর ২০০৮।
ZENO KALIED - এই হলো আমাদের বাড়ির নতুন ভাড়াটের নাম। ও আপাতত ছোট ঘরটায় উঠেছে। চিলেকোঠায় আমার ঘরটা বিশাল। সামনে মাসে আমি সুইৎজারল্যান্ডে অন্য চাকরী নিয়ে চলে যাব, তখন আমার ঘরে চলে আসবে। বাড়িওয়ালার সাথে সেরকম কথা হয়ে আছে। সাতাশ বছর বয়েস, আমার পঁচিশ। চেহারা ভারীর দিকে। মুখে একটা স্পষ্ট মধ্য-প্রাচ্যের ভাব রয়েছে। গায়ের রঙ তামাটে, অ্যাভারেজ হাইট। আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই বিদেশে অচেনা লোককে করা বাঁধাধরা এবং মরচে-ধরা প্রশ্নটা এসে পরল। “Where are you from?”
ছেলেটা বেশ গর্বিত ভাবে বলল, “আমি কুর্দিশ। নর্থ ইরাকে আমি জন্মেছি। কিন্তু আমি ইরাকী নই, নিজেকে কুর্দিশ বলতে বেশী পছন্দ করি।”
তৃতী বিশ্বের নাগরিক আমি--- প্রথম বিশ্বে এসে তক ইরাক ইরান সম্বন্ধে যা জেনেছি CNN BBC দেখেই শিখেছি। ইরাক মানেই আমার চোখে ক্যারিশ্ম্যাটিক এবং নৃশংস সাদ্দাম হোসেন। পাঠক, মনে রাখবেন ঘটনা ২০০৮ এর। সাদ্দাম কিছুদিন আগেই মারা গেছেন— আমেরিকান সৈন্যরা অতীতের প্রবল পরাক্রমশালী সাদ্দামকে গর্ত থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে মেরেছে। তো যাই হোক, আমি হাল্কা করে সাদ্দামের নামটা তুলতেই, ZENO বলে উঠল, “We are against Saddam. We fought against him.” আমি হিসেব করে দেখলাম যে ’৯১ সালে যখন ZENO ইরাক-ইরাণের যুদ্ধের সময় ইরাক ছেড়ে এসেছে তখন ওর বয়েস মোটামুটি এই দশ-এগারো। অর্থাৎ তখনই ঐ বয়েসেই ওর মধ্যে গৃহযুদ্ধের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে। ZENO আমায় বলল, দেশ ছাড়ার আগে ও অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গেরিলা যুদ্ধ দেখেছে। ওরা কাছে ১৯৫৮ সালের একটা ছবি রয়েছে যেটা ও দেশ ছেড়ে আসার সময় নিয়ে আসতে পেরেছিল। ছবিতে ওর ঠাকুর্দা— গেরিলা যোদ্ধাদের লীডার অন্য গেরিলা যোদ্ধাদের সামনে দাঁড়িয়ে গার্ড অফ অনার নিচ্ছেন।
ZENO শুধু দেশ নয়, নিজের জীবন নিয়েও খুব গর্বিত। ও বলে চলে, জীবনের যে রুক্ষ কঠিন রূপ ও দেখেছে সেটা অকে মানসিকভাবে পাথর হয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সেইসাথে ZENO এটাও বলে, “আমি চাই না অন্য কেউ সেই রূপ দেখুক।” নিজে থেকে বলে যায়। দ্যাখো জয় (লেখকের ডাকনাম)— আমার কোন ডিপ্লোমা নেই। আমি তোমার মত কোনদিন ইউনিভার্সিটিতে যাই নি, যাবোও না। তোমার মতো স্মার্ট নই, গুছিয়ে কথা বলতে পারি না ইংরেজীতে। কিন্তু আমি ইতিহাসে, ভূগোলে খুব ভালো। I may be poor in mathematics. But I can pick up new languages very easily. এই তো এখন ডাচ, ইতালিয়ান, কিছুটা ফ্রেঞ্চ শিখে গেছি।”
আমি কুর্দিশদের সম্পর্কে আরো আগ্রহ প্রকাশ করলে জাত্যভিমানে ফুটতে থাকা ZENO আমায় বলে— কুর্দিশরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ইরাক, তুর্কী, মরক্কো। গর্ব ফুটে ওঠে ওর চোখে মুখে যখন ও বলে যে ক্রুসেডের যুদ্ধে বীর সুলতান সালাউদ্দীন (ZENO এর উচ্চারণে সালে-ই-দিন) ইংল্যান্ডের নাইট রিচার্ডের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন— তিনি কুর্দিশ। ক্রুসেড থেকে আলোচনা অনিবার্যভাবে গড়িয়ে যায় অধুনা আমেরিকায়। ইরাকে আমেরিকা যা করছে সে প্রসঙ্গে ZENO প্রথমে বলল, আমেরিকা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেগুলো যথারীতি কিছুই পালন করে নি। আমেরিকা নিয়ে কথা বলতে বলতে ZENO বলে তোমায় একটা প্রাচীন কুর্দিশ গল্প বলি শোনো। একটা পাখির ডানা ভেঙে গেছে। সে আর উড়তে না পেরে মাটিতে পরে গ্যালো। এমন সময় একটা গরু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আবার সেই পাখিটার ওপরে গোবর ফেলে দিয়ে চলে গ্যালো। তাতে তো পাখি আরোই নড়তে চড়তে পারে না। সে খানিক গরুকে গালাগালি করল। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে একটা বাঘ সেই পাখিতা যেটা গোবরে আটকে ছিল তাকে গোবর থেকে তুলল। জিভ দিয়ে চেটে চেটে গোবর পরিষ্কার করল। তারপর পাখিটা যখন একটু সুস্থ হয়েছে তখন বাঘটা তাকে খেয়ে নিলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি— গল্পের তাৎপর্য অনুধান করার মরিয়া প্রচেষ্টা করছি। ZENO আমার অবস্থা আন্দাজ করে বল, শোনো এ গল্পের মর্যাল হচ্ছে— যারা তোমায় সাহায্য করছে তারা সবাই তোমার বন্ধু নয়।
মানুষ তার রক্তাক্ত অতীতে ফেরত যেতে যায় না। বাংলাদেশ থেকে একবস্ত্রে যাঁরা চলে এসেছিলেন এ পারে তাঁদের অনেকেই সেই কষ্টকর শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করতে চাইন না। কিন্তু গল্প শুনতে আগ্রহী যারা, তাদের মধ্যে একটা মরীয়া ভাব থাকে। রিপোর্টারদের মধ্যে এই গুণটা তো খুব’ই জরুরী। তো আমি খিনিক ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেফেললাম, গালফ যুদ্ধের কোন স্মৃত মনে পড়ে তোমার, ZENO? দেশ থেকে পালিয়ে আসার আগের কোন ঘটন নাড়া দ্যায় এখনো? ZENO বলতে চাইছিলো না। নিজের মনেই টুকটাক কথা বলছিল— দশ বছর বয়েসে এত মৃতদেহ দেখেছে সে। চোখের সামনে চেনা মানুষ সামান্য কারণে অন্য আরেকজন চেনা মানুষের প্রাণ নিয়ে নিলো। এ প্রতিদিনের ঘটনা। এসব কষ্টের স্মৃতি এখনো ওকে তাড়া করে বেড়ায়। “আমি দেখছি এক মস্ত বড়লোক তার দামী ইউরোপীয়ান গাড়ি সহ বাক্সভর্তি সোনাদানা গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে তুলে দিচ্ছে— বিনিময় স্রেফ দুটো ঘোড়া পাওয়ার জন্যে। তুমি ভাবো— মধ্য প্রাচ্যে অর্থাৎ তেলে ভাসমান একটি ভূখন্ডে বসেও সেই লোকটি তার নিজের গাড়ির জন্য পরিশোধিত তেল যোগাড় করে উঠতে পারে নি। তাই চলাফেরার জন্যে ঘোড়াই একমাত্র ভরসা। গেরিলাদের আমেরিকা টিনে করে তেল দেয়। তাদের ঐ গাড়িটা কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
আচ্ছা, তোমরা ইরাকে ফুটবল খেলতে?
ZENO বলে চলে, “ফুটবল এমন একটা খেলা সবাই খেলে। আমরাও ছোটবেলায় খেলতাম। তবে গৃহযুদ্ধ চলছে। মানুষ পরের দিন কী খাবে ঠিক নেই। তাই প্রকৃত ফুটবল পাওয়া যেত না। কিছু একটা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে নিতাম। ছেঁড়া ন্যাকড়া এইসব আর কী!” ZENO হাসে। “গৃহযুদ্ধের সময় আমরা প্রায়ই মিলিটারি অথবা গেরিলাদের পরিত্যক্ত আস্তানায় ঢুকে পরতাম। অনেকসময় খেলার জিনিস, সিগারেটের বাক্স, মিলিটারির ফেলে যাওয়া বাসন-কোসন বা অন্য কোন জিনিসের লোভে। ওরা যখন ফাঁকা করে দিয়ে চলে যেত, সব নিয়ে যেতে পারত না। তো একবার এরকম একটা পরিত্যক্ত মিলিটারি বেসে ঢুকে পরেছি বুঝলে। কত বয়েস হবে? ঐ নয় কী দশ। আমার সাথে আমার বন্ধুরাও আছে। সবাই ফেলে যাওয়া কাগজপত্তর কাঠের আসবাবপত্র ঘাঁটছি। যদি কিছু পাওয়া যায়। আমার সামনে পরে আছে একটা ভাঙা কাঠের কাবার্ড। ভিতরে দেখলাম বেশ চ্যাপ্টা মোটা গোল গোল কীসব রাখা আছে। এই আট-দশ ইঞ্চি মত ডায়ামিটার। হাতে নিয়ে দেখলাম, ফুটবল বানানো যাবে কীনা। কিন্তু চ্যাপ্টা জিনিসে ন্যাকড়া জড়িয়ে তাকে গোল বল বানানো বহুত হ্যাপা। আর টেঁকে না। ন্যাকড়া সহজে খুলে যায়। খুব একটা কাজে দেবে না। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে ঐ কাবার্ডেই রেখে দিয়ে বন্ধুদের সাথে চলে এলাম। এর দুবছর বাদে আমি ইউরোপ চলে আসি। নেদারল্যান্ডে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে একদিন টিভি চালিয়েছে। টিভিতে গালফ যুদ্ধের ছবি দেখাচ্ছে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। দেশের ছবি বলে কথা। হঠাৎ দেখি টিভির পর্দায় ভেসে উঠছে ঐ গোলগোল জিনিসগুলোর ছবি। ওগুলো গেরিলাদের বানানো ল্যান্ড মাইন।”
ZENO র শেষ কথাগুলো আমার সবুজ ডায়েরীতে লেখা রয়ে গ্যালো। “টিভিতে মাইন দেখে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল জানো। ঠিক ঐ জিনিসটাকেই— মানে সাক্ষাত মৃত্যুকে আমি ফুটবল ভেবে নাড়াচাড়া করে এসেছি। I really hope no other kid opened that cupboard ever. But I won’t know for sure. In all probability, someone did.”


No comments:

Post a Comment