Saturday, August 16, 2014

সূর্যগ্রহণ ও ছেঁড়া পরোটা

কিছু কিছু মানুষ বিজ্ঞানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হন। স্কুলের স্যারেরা পড়তে বলেছেন বলেই সায়েন্স পড়েছেন অথবা মাধ্যমিকে বেশী নম্বর পেয়েছেন বলেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছেন এরকম নন। মাধ্যমিক ব্যাপার’টা অবশ্য উঠে যাচ্ছে (বা গেছে)।

এরকম একজন মানুষ হলেন আমার বাবা। আমার বাবা বৈজ্ঞানিক নন, কিন্তু নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কিনে ফেলা এবং অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার বাবার স্বভাব। বহুদিনের স্বভাব।

ক্লাস সিক্সের আমি একজোড়া ওয়াকিটকির একটা নিয়ে ডক্টর’স কোয়ার্টারের সামনের মাঠ পেরিয়ে একদম শেষে চলে গেছি। তিনতলার কোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবা অন্য ওয়াকিটকিটায় জোরে জোরে বলে যাচ্ছে, “শোনা যাচ্ছে? কি রে, শুনতে পাচ্ছিস? দোকানে বলেছে মিলিটারি গ্রেড। এক কিলোমিটার অব্দি কাজ করবে।”

শোনা যাচ্ছে, এবং আমি প্রাণপণ চেল্লিয়ে (যদিও দরকার ছিল না, ওয়াকিটকি কাজ করছিল) সেটা জানান দেওয়া মাত্র নির্দেশ এলো – আরো দূরে যা। মুশকিল হচ্ছে আড়াআড়িভাবে মাঠ পেরোনোর পরে কচুরিপানার জঙ্গল।

মফস্বল থেকে এটাও উঠে যাচ্ছে। মশার যেমন গুড নাইট, কচুরিপানার প্রোমোটার।

যাগ্‌গে, কার্গিলে কম্যান্ডারকে পরিস্থিতি জানানোর মত তৎপরতায় (স্যালুট ছাড়া) বাবাকে জানালাম যে আর এগোনো সম্ভব নয়। সামনে ওয়াটার ফ্রন্ট।

"হুম্‌, তাহলে আর কি। ফেরত চলে আয়। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ হল কি বলিস ... বেতার ফোন। তুই এবার পাড়ার মধ্যে কোথাও গেলে এটা নিয়ে যাবি। মুদীর দোকানে গিয়ে কত গ্রাম বেগুন মনে না পড়লেই মাকে ওয়াকিটকিতে - ওভার অ্যান্ড আউট।"
বলা বাহুল্য – ঘটনা আর এগোয় নি। ওয়াকিটকির সেই শুরু আর সেই শেষ – পঁচানব্বই সালে কেনা সাত হাজার টাকার ওয়াকিটকির প্রথম ও শেষ ব্যবহার।

ওই সময় নাগাদ আরেকটা ব্যাপার ঘটেছিল, যেটা এক্ষুণি লিখে ফেলা দরকার। সূর্য গ্রহণ। পূর্ণ গ্রহণ।

ডায়মন্ড রিং বলে একটা ব্যাপার দেখা যাবে যেটা জৌলুসে পি সি চন্দ্র কে বলে বলে দশ গোল দেবে।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল সেই অঙ্গুরীয় আমাদের খড়দার কোয়ার্টারের ছাদ থেকে দেখা যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে বারুইপুর হচ্ছে এই শো’র ব্যালকনির সিট। খড়দা থেকে গ্রহণ দেখা নিশ্চয়ই যাবে, কিন্তু ওই ড্রেস সার্কেল মার্কা দেখা হবে।

সুতরাং শুভ দিনে আমরা মেন লাইনের ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ এবং সাউথের ট্রেন পাকড়ে বারুইপুর চেপে এলাম। ট্রেনে আসা শুধু মাত্র সুবিধেজনক ছিল না, বাধ্যতামূলক ছিল। কারণ আমার চারচাকা সংক্রান্ত মোশন সিকনেস।

ক্লাস নাইন অব্দি আমার একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল – বাসে উঠে ঠিক সাত মিনিটের মাথার হড়হড় করে বমি করা। উইদাউট ফেলিওর। ওপেন করে সচিনের সেঞ্চুরির মত। বা ক্লাবের হয়ে মেসির গোল করার মত। তার থেকেও নির্ভুল, নিশানায় অভ্রান্ত।

পেটে খাবার নেই, মানে বাড়ি থেকে না খাইয়ে আনা হয়েছে ব্যাপারটা আটকানোর জন্য। কোই পরোয়া নেই, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে বেরোনো হর্মোনগুলো, আমার পাকস্থলী সার্চ করে কিছু না পেয়ে পিত্ত তুলে আনত। সেই প্রথম জানা পিত্তি জ্বলে যাওয়া কাকে বলে। আক্ষরিক অর্থে।

শুরুর দিকে বাবা-মা কি করে সামলাতেন সেটা আমার মনে নেই। ক্লাস ওয়ান-টু থেকে যেটা শুরু হয়েছিল – বাসে উঠেই মা জানালার ধারে বসা কাকু-কাকিমাকে বলতেন, “ওকে জায়গাটা ছেড়ে দেবেন প্লিজ, মোশন সিকনেস আছে। একটু পরেই বমি করবে।” কেউ কেউ বিশ্বাস করে, দয়া-পরবশ হয়ে ছেড়ে দিতেন। আর যাঁরা দিতেন না, মা তাঁদেরকে সতর্ক করতেন, “দেখুন ও কিন্তু সত্যিই করবে, জানলার পাশে বসলে বাসের বাইরে, নইলে ......”
এই পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষ অসম্পূর্ণ কথার মানে বুঝতে পারেন না। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখেছি তাঁরা পস্তান। এক্ষেত্রেও অন্যথা হত না। তাঁরা গোঁ ধরে জানলার ধারে বসে থাকতেন। এবং ঠিক ছয় মিনিট বাদে (কথাবার্তায় এক মিনিট কেটে গেছে) ব্যাপারটা ঘটত।

বহু অভিশাপ সংগ্রহ করেছি আমি এই পদ্ধতিতে। পার্টিতে মদে অচেতন বন্ধু/বান্ধবীকে উদ্ধার করার সময় একটা একটা করে অভিশাপ কাটাই। কিন্তু জন্ম থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত সব অভিশাপ কাটাতে গেলে আমাকে যে পরিমাণ পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হবে, সেটা ঠিক ...

বেশ খানিকটা বাজে বকে দিলাম। ব্যাক টু বারুইপুর। বিজ্ঞান সংসদের চশমা জোগাড় করে হয়েছে সূর্য গ্রহণ দেখার জন্য। কিন্তু চশমা’টা কি সত্যিই পর্যাপ্ত পরিমাণে কালো? মানসিক শান্তির জন্য শেষ মুহূর্তে হাসপাতালের নষ্ট হওয়া নিকশ কালো এক্স রে প্লেটেই ভরসা রাখা হল।

তারপর দেখা গেল – ডায়মন্ড রিং। কালো এক্স রে প্লেটের মধ্যে দিয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়া আকাশকে আরো কালো করে দিয়ে, হঠাৎ চারপাশে ঝটফটিয়ে পাখি উড়ে যাবার শব্দ। কিন্তু ওই বিশেষ দিনটির কথা আমার হীরের আংটির জন্য মনে নেই।

মনে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া পরোটার জন্য।

আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ছোটোবেলা থেকে চারপাশ দেখেই সেই ধারণা গড়ে উঠেছিল – পরোটা সংখ্যা গুণে বিক্রী হয় – এবং অর্ধেক বা ছেঁড়া বিক্রী হয় না। এটা যেন একটা থিওরেম। পরোটা থিওরেম।

আংটি দেখে যখন আমি আর বাবা বারুইপুর স্টেশনে তন্নতন্ন করে খাবার-দাবার খুঁজছি – তখন দেখা গেল রাশি রাশি পরোটা ছিঁড়ে ওজন করে বিক্রি হচ্ছে। রীতিমত দাঁড়িপাল্লার একদিকে ওজন আর অন্যদিকে পরোটা। পরোটার দিকে ওজনে বেশী হয়ে গেছে। দোকানি একটু ছিঁড়ে কমিয়ে দিলেন।
আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমি আর বাবা মিলে তিনশো (গ্রাম) পরোটা খেয়েছিলাম। আমার পরোটা থিওরেম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছিল।

ঠিক পরের স্কুলের বাংলা পরীক্ষায়, রচনায় তিনটে অপশন ছিল - রবীন্দ্রনাথ, বর্ষাকাল আর সূর্য গ্রহণ। সেফ রবীন্দ্রনাথ এবং ততোধিক সেফ বর্ষাকাল ছেড়ে সূর্য গ্রহণের মুখোমুখি হয়েছিলাম – ভালো নম্বরের আশায়। আনকমন টপিক লিখলে স্যারেরা বুঝতেন যে খাতায় উগরে দেয় নি, নিজে লিখেছে। নম্বরটাও ঢেলে দিতেন।

কিন্তু তিন পাতার রচনার মধ্যে এক পাতা পুরোটাই ছেঁড়া পরোটার বর্ণনা থাকায় স্যার রচনায় ভালো নম্বর দিতে পারেন নি। ডেকে বলেছিলেন, “দ্যাখ্‌ পরোটার সাথে সূর্য গ্রহণের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তুই লিখেছিস্‌ ভালোই, কিন্তু তাও নম্বর দিতে পারলাম না!”

আজো পৃথিবীর যে কোনো কোথাও, অথবা ইন্টারনেটে সূর্য গ্রহণের ছবি দেখলেই আমার মনে পড়ে – শরতের পেঁজা তুলোর মতন নরম ছেঁড়া ছেঁড়া পরোটা।

10 comments:

  1. Thik jomlo na...tomar standard ekhon onek high hoye gache....tai expectation tao beshi.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. হুম্‌ হুম্‌ এবং তৃতীয় হুম্‌ ... চেষ্টা জারি আছে। তবে কিনা পাঠককুলের থেকে আরো উৎসাহের প্রয়োজন।

      Delete
  2. এই দুষণে ভরা কর্পোরেট জীবনে তোমার কলম ই আমাদের অক্সিজেন।
    মৈনাক এর সাথে আমিও বৃষ্টিতে ভিজেছি,
    বিপিন বাবুর সাথে মেস বাড়িতে rum আর chicken tandoori গোগ্রাসে গিলেছি।
    ইদুর দৌড় এর রঙ্গমঞ্চে তোমার এই বিপ্লব রা দির্ঘজবি হোক।
    তোমার প্রয়াস কে শত সহস্র লাল/নিল সেলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চাইলাম কুল, আর তুই তো একেবারে আম, লিচু, বেদানা নিয়ে হাজির। তোর দাবিটা বুইচি, প্লট ভাবতেসি।

      Delete
  3. অনেক দিন ধরে দেখার পর আজ পড়লাম | খুব ভালো লাগলো, আফসোস হল, এতদিন কেন পড়িনি

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে কদ্দিন বাদে। আপনি চুপকথার সম্ভবত বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠক। তাই আপনার কমেন্টের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে।

      Delete
  4. Shabash, tahole jana gelo je porota quantized noi. Amar o dharona chilo na je porota chire bikri hoi !

    ReplyDelete
    Replies
    1. ghonada, byaparta amar sishu mone tahole kirom provab felechhilo vabun dekhi! asole amader ase-pashe je gulo hoy, hotei thake, je gulo niye amra bere uthhi, se gulokei amra dhrub-sotyo dhore ni .. tar baire je anyorokom kichhu hote pare, chokhe na dekhle seta biswas kore uthte pari na ..

      Delete
  5. স্যারের নম্বর না দেওয়া টাকে আমি একদম সমর্থন করতে পারলাম না। সূর্যগ্রহণের সাথে পরোটার সম্পর্ক না থাকলেও নম্বর দেওয়া উচিত্‍ ছিল, :@

    ReplyDelete