Thursday, December 18, 2014

রেনকোটের বৌদি

আপনি কি বুম্বাদার সিনেমা দেখেন?

জানি আপনি অনেক ভালো ভালো সিনেমা দেখেন। আপনার অনেক অগাধ জ্ঞান, দেশ বিদেশের সিনেমা নিয়ে কফি টেবিল থেকে শুরু করে, টেংরি কাবাব পেরিয়ে জিঞ্জার টি অব্দি আপনি আসর জমিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু আপনি কি সেইরকম বাঙ্গালি যার ফেসবুক বা কিছু একটায় ঘোষিত সেরা দশ বই এর মধ্যে একটাও বাংলা বই আসে না। দিল্লী-বোম্বে-জুরিখ-হনলুলু-টেক্সাসে পড়াশোনা করেছেন বা এই ধরণের কোন আন্তর্জাতিক শহরের দশ মাইল দূরের গ্রামে থাকেন বলে - (দম নিয়ে) - আপনার ঠিক আজকালকার বাংলা সিনেমা, মেনস্ট্রীম সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে না।

এগুলো হয়ে থাকলেও আপনার সামনে ফেরার একটা সুযোগ আছে। কারণ অঞ্জন দত্ত বলে গেছেন, শেষ বলে কিছু নেই

অঞ্জন থেকে অনুপমে ফেরত আসা যাক। আমার মতে, বুম্বাদার মত কেউ নেই। এই ভদ্রলোকের সিনেমা দেখার জন্য আমার অনেক শিক্ষিত-আধাশিক্ষিত-এবং-অশিক্ষিত বন্ধুর মন আঁকুপাকু করে। তারা বুম্বাদার সিনেমা দেখতে গিয়ে আইসল্যান্ড বেড়াতে যাওয়ার মহার্ঘ্য প্লেন মিস করে। তারপর দেরি করে আইসল্যান্ড গিয়েও হোটেলে বসে বুম্বাদার সিনেমা গেলে।

ব্যাপারটা আরেকবার বলছি, ‘প্রোসেনজিতের' সিনেমা নয়, বুম্বাদার সিনেমা। অর্থাৎ কিনা যিনি নিজেই ইন্ডাস্ট্রী, তার সিনেমা। কোটি কোটি নায়িকা-অভিলাষী বাঙ্গালি মেয়েকে যিনি রুপোলী পর্দার পথ দেখিয়েছেন। সুচিত্রা সেন ছাড়া সমস্ত অভিনেত্রী যার সাথে ছবি তুলতে চান। সেই বুম্বাদা।

অনেক ছোটবেলায় আজকাল পত্রিকায় পাঠকের চিঠি বেরিয়েছিল। বুম্বাদা বাজে অভিনয় করেন, সিনেমার গল্পে কোন সারবত্তা নেই। অভিনয় জানেন না, শুধু ডান গালের পেশী কাঁপিয়ে একটা মেলোড্রামা অভিনয় করেন, ইত্যাদি।

তাঁর প্রতি উত্তরে বুম্বাদার নিজের কলমে একটা চিঠি বেরিয়েছিল। তাতে পাঠকের চিঠির মৃদু প্রতিবাদ করে বুম্বাদা লিখেছিলেন, যে তিনি ডান গালের নয়, বাম গালের পেশী কাঁপিয়ে থাকেন। এ ভাবে তাঁর গাল’কে মিস্কোট করা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। এবং ওই ভাবে একনাগাড়ে গাল এর পেশী সংকোচন প্রসারণ যথেষ্ট পরিশ্রমের এবং স্কিলের কাজ।

সত্যি ঘটনা।

তো মোদ্দা কথা, মাঝে মাঝে বুম্বাদার সিনেমা দেখবেন। শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, দাঁত চকচকে হবে না কিন্তু হৃত আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে।

একটা বাংলা মুভি চ্যানেলে সেরকম’ই একটা সিনেমা হচ্ছিল। নাম - ‘ভালোবাসার ছোঁয়া’। অনেক দিন বাদে বুম্বাদার সিনেমা। মনটা আনচান করে উঠলো।

কিন্ত কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম, নাহ্‌ বুম্বাদা নয়, নায়িকাই বেশী মন টানছেন। নায়িকা নবাগতা, মানে যখন সিনেমার শুটিং হয়েছে তখন নবাগতা। ইনফ্যাক্ট এই ভদ্রমহিলার খুব একটা সিনেমা বা পোস্টার দেখেছি বলে মনেও করতে পারলাম না। এখন নিশ্চয়ই তিনি সুখে সংসার করছেন, এ লাইন ছেড়ে দিয়েছেন।

হঠাৎ মনে মনে শিউরে উঠলাম। এ কি হল? বুম্বাদার থেকে বেশী মনোযোগ নায়িকার দিকে চলে যাচ্ছে। মিড লাইফ ক্রাইসিস কি এভাবেই দরজায় টোকা দেয়?

গভীর ভাবে ভদ্রমহিলাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। এখন কিরকম একটা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক ভালো একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। অনেক দিন আগে কোথাও একটা ওনাকে দেখেছি।

কোথায়? কোথায়? কলেজের পাশের ডিপার্টমেন্টের ব্যথা? নাকি কলেজ সোশালে অন্য কলেজের ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রী? কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

চল্লিশ তো দেরি আছে, চালশে কি সিঁড়ি বেয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল?

রং চঙে ঘাগরা পরে ভদ্রমহিলা নেচেই যাচ্ছেন। হাসছেন, কাঁদছেন, শক্তপোক্ত ভিলেন কে চড় মারছেন। পটল চেরা চোখ থেকে ভুবনমোহিনী হাসি ছাড়ছেন। বুম্বাদার ওভার সাইজড্‌ জামার হাতা নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ভীরু হরিণীর মত ক্যামেরার দিকে নয়নপাত করছেন।

ইনি কে?

এখানে একটা স্বীকারোক্তি খুব প্রয়োজন। আমি প্রপার নাউনে খুব দুর্বল। মানে নাম মনে রাখতে পারি না। লোকের নাম, জায়গার নাম, খেলার নাম, ব্র্যান্ডের নাম। কম্পিউটর, হার্ড ডিস্ক, লিঙ্কড্‌ লিস্ট ইত্যাদি আবিষ্কার না হলে আজ আমায় রাশি রাশি কাগজ সাথে করে উর্ধশ্বাসে ঘুরে বেড়াতে হত, অথবা ‘গজনী'গামী হতে হত।

আমার বৌয়ের আবার এই ব্যাপারটা খুব স্ট্রং। নাম-ধাম-ম্যাপ-গানের কথা ইত্যাদি মনে রাখার ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে তার। বাধ্য হয়ে ডাকলাম।

- দারুণ দেখতে না রে। (নাম জিজ্ঞেস করার আগে একটু পরিবেশ তৈরি করার অছিলা)
হ্যাঁ
চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক ...
এ তো রেনকোটের বৌদি।

রে - ন - কো - ট, বৌদি ?! মানে ঋতুপর্ণের রেনকোট?


হ্যাঁ রে বাবা, মৌলি ... মৌলি কি যেন? মৌলি গাঙ্গুলি।

নাম আমি মনে রাখতে পারি না, কিন্তু সংলাপ পারি। এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল। সংলাপটা।

শীলাঃ বিয়ে হয়ে যাওয়া পুরনো প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন, খালি হাতে যাবেন?
মন্নুঃ আচ্ছা, বলতে পারেন, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে মেয়েরা এত কাঁদে কেন?
শীলাঃ কেন, আপনার প্রেমিকার যখন বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তখন সে খুব কান্নাকাটি পরছিল বুঝি?
মন্নুঃ নাহ ওর বিয়ের সময় তো আমি ছিলামই না। (একটু সময় নিয়ে) আপনার সাথে যখন আমার বন্ধুর বিয়ে হল। বিয়ে বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় আপনি পুরো রাস্তাটা কাঁদতে কাঁদতে গেলেন। সেটা কি শুধু বাড়ির লোকেদের কথা মনে করে?

(একটু অপ্রস্তুত, তারপর সামলে নিয়ে) শীলাঃ এরপর থেকে বাথরুমে যখন কাঁদবেন, শাওয়ারটা মনে করে অন করে দেবেন। মেয়েদের থেকে আপনাদের এরকম দু’একটা ব্যাপার শিখে নেওয়া উচিত।
--

রেন কোট প্রায় ৯৯% ইন্ডোর সিনেমা। ও হেনরীর গপ্পের ভারতীয় ভার্সন। আমি বলছি না, এন্ড ক্রেডিটে ঋতুপর্ণ নিজেই বলেছেন।

সম্পুর্ণ ইনডোর শুটিং করলে সিনেমা নাকি জমে না, যাত্রা যাত্রা ভাব চলে আসে। সমালোচকেরা এরকমই বলেছিলেন সত্যজিতের ‘গণশত্রু’ নিয়ে। অসুস্থ সত্যজিত ডাক্তারের নির্দেশে আউটডোর শুটিং ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে ছেঁটে ফেলতে বাধ্য হন। ফলে ধৃতিমান ও সৌমিত্র’র ধুন্ধুমার মানসিক টানাপোড়েন, সামাজিক অন্ধ বিশ্বাস আর ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে যুক্তিবাদী মন, ‘চার দেওয়ালের মধ্যেই' হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য হয়।

রেনকোটে অবশ্য একটি আউটডোর অংশ আছে। শুভা মুদ্‌গলের গানের সাথে কালো ধোঁয়া ছাড়া ইঞ্জিন। এই একটা অ্যাডভান্টেজ বাদ দিলে, আমার মতে রেনকোট আর সব দিক থেকেই গণশত্রুর থেকে এগিয়ে। এ ধরণের গপ্পে চরিত্রের সংখ্যা কম হলে মূল গল্পটা ফোটে ভালো, বিশেষত দুটো গল্পেই যেখানে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। এর সাথে যোগ হবে গণশত্রু’তে গানের অভাব - ঋতুপর্ণ’র মৈথিলী ভাষাজ্ঞান, ফলোড বাই গুলজারের এডিটিং, রেনকোটের গান গুলোকে সিনেমার অংশ করে তুলেছে। মানে রেনকোট সিনেমাকে বাদ দিয়ে ওই গানগুলোর কথা ভাবাই যায় না, এবং ভাইস-ভার্সা।

মানে ঠিক অনুপম রায়ের গানের মত নয় - যে যে কোন হতাশ প্রেমিকের গলাতেই মানাবে। নির্দিষ্ট কোন সিনেমা বা কোন দৃশ্য মনে করিয়ে দেবে না।
--

এই যে শীলা মজুমদারকে দেখে আমার রেনকোট সিনেমা’টা প্রায় পুরোটা ফ্রেম বাই ফ্রেম মনে পড়ে গেল, এটা কি সিনেমাটা গণশত্রু’র থেকে ভালো বলে?
--

মন্নুঃ বিয়ে বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় আপনি পুরো রাস্তাটা কাঁদতে কাঁদতে গেলেন। সেটা কি শুধু বাড়ির লোকেদের কথা মনে করে?



5 comments:

  1. অনেকদিন পরে উস্কে দিলে হে, বর্ষাতির স্মৃতিটা, আমার খুব প্রিয় সিনেমা ওটা। :)
    লেখার স্টাইলটা বেশ অন্যরকম লাগলো।
    এবারে ভাবছি 'ভালবাসার ছোঁয়া' সিনেমাটা দেখব, পরেরবার টিভিতে যখন দেখাবে। :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. হে হে ... ভালোবাসার ছোঁয়া খুব রেয়ার সিনেমা। ইন্টারনেটে পাবে না। বুম্বাপ্রেমীদের জন্য টিভি তে এক্সক্লুসিভলি দেখানো হয়।

      বর্ষাতি নিয়ে একদম একমত।

      Delete
  2. Daarun laaglo pore, amaar khub khhub pachhander cinema, tobe gaan gulo aage na cinema ta aage bolte paarbo na :P

    ReplyDelete
    Replies
    1. sei .. ei dwidha ta oneker modhyei achhe .. director ar lyricist aki lok na hole sera bachha khub kostokor hoto ..

      oboshyo sera bachhtei ba hobe kano?

      Delete
    2. ekdom thhik..sera bachhabachh-ir kono dorkaar nei..bhalo laga ta purotai amaader paona :)

      Delete