Saturday, October 11, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ (প্রথম পর্ব)

ইমিগ্রেশনের কাগজটা দিয়ে গেল। বাপ-ঠাকুর্দার ঠিকুজী কুষ্ঠী, কত টাকার জিনিস নিয়ে দেশে ঢুকছেন তার লম্বা ফর্দ।

ভদ্রলোকের টাকমাথা, নুয়ে পড়া চেহারা। দশটা-পাঁচটার সরকারী চাকরি করা বয়স্ক একজন মানুষ যেমন দেখতে হয়। একটু এদিক ওদিক দেখে, মাথাটাকে আরো কয়েক ইঞ্চি নুইয়ে দিয়ে, আমার কানের কাছে এনে, প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ে ... উইল ইট বি ওকে … যদি আমি … মানে … ইফ আই ... ড্রিঙ্ক ... দুত্তেরি ... মানে ... টেক সাম হুইস্কি।

আমি ঠিক সেই মুহূর্তে খুব বোদ্ধার মত স্কচ-অন-দ্য-রক্‌স ব্যাপারটা নামানোর চেষ্টা করছি। তবে কিনা ইকনমির টিকিট থুড়ি রেড লেব্‌ল, তাই অ্যাপেল জুস না মিশিয়ে ব্যাপারটা গলা দিয়ে ঢালা যাচ্ছে না।

এদিকের ঘটনা ঠিক পরিষ্কার নয়। আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে নুয়ে পড়া কাকু, নীল জ্যাকেটের সাইড পকেট থেকে, প্লেন কোম্পানির ছাপ মারা, রেড লেবেলের ছোট্ট প্লাস্টিকের বোতলটা একটুখানি বার করে দেখালেন।




ওঁকে কিছুটা থামিয়ে দিয়েই বলে ফেললাম, কাকু দু লিটার লিমিট, এয়ারহোস্টেস আপনাকে যেটা দিয়েছেন সেটা মোটে পঞ্চাশ এম এল। কাস্টম্‌স আপনার দিকে তাকিয়েও দেখবে না। ওরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না। আর আপনি তো রীতিমত উইদিন ইয়োর লিমিট্‌স। বুক ফুলিয়ে গট গট করে বেরিয়ে যাবেন।

আর হ্যাঁ, আমি বাংলা বলতে পারি। একটু আগে এয়ারহোস্টেসের সাথে ইংরেজীতে কথা বললাম, কারণ এয়ারহোস্টেস বাংলায় কথা বলতে পারেন না।
এবার একবারও ধাক্কা না খেয়ে সাবলীল নুয়ে পড়া কাকু, তুমি নিয়েচো? মানে হার্ড ড্রিঙ্ক্‌স নিয়েচো?

আচ্ছা যন্ত্রণা!
আমি কি সত্যিই দিন কে দিন সুবোধ বালক টাইপ দেখতে হয়ে যাচ্ছি? এরকম প্রশ্ন হঠাৎ?

বরফ আর স্কচের সূক্ষ্ম ব্যালান্সটা মুলতুবি রেখে ভালো করে তাকাতেই হল।
প্লেনের সিটে বসে থেকে অব্দি, ভদ্রলোকের নুয়ে পড়া চেহারাটা ছাড়া আর একটাও বিশেষত্ব চোখে পড়ে নি। গভীর রাতের ফ্লাইট, তাই দরজা বন্ধ করেই তড়িঘড়ি করে সব্বাইকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখনই প্রথম ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর শুনলাম।

উজ্‌ য়ু লাইক টু হ্যাভ অ্যা ড্রিঙ্ক স্যার?
স্বর্ণকেশী ছয় ফুটিয়ার দিকে তাকিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে নুয়ে পড়া কাকু, ইয়েস। ওনলি হার্ড ড্রিঙ্ক্‌স।

নুয়ে পড়া কাকু খুব মন দিয়ে এমিরেটসের ইকনমি ক্লাসের ভিডিওতে প্লেনের যাত্রাপথ দেখছেন। ওনাকে নুয়ে পড়া কাকু বলতে আর ইচ্ছে করছে না। নুয়ে পড়া কথাটার মধ্যে কিরকম একটা অসম্মান মিশে আছে।
অথচ প্লেনে উঠে অব্দি ভদ্রলোক ঘাড় নুয়ে বসেই আছেন।
আমি ভালো নাম দিতে পারি না। বিনয় করছি না, প্রুভেন সমস্যা। দু-একজন হলেও-হতে-পারে প্রেমিকার এরকম অভিযোগ ছিল।

আপাতত সুবিধের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক ওনার নাম নুপ কাকু।

নুপ কাকু প্লেনে উঠে থেকেই কড়া নজরে রেখেছেন পুরো সিস্টেমটাকে। মানে প্লেন বেচাল হচ্ছে কিনা, ট্র্যাফিক জ্যামে স্লো হয়ে যাচ্ছে কিনা। মাঝে মাঝে প্লেনের স্পিড আর টাইম টু ডেস্টিনেশন দিয়ে গুণ করে কলকাতা কদ্দুর সেই হিসেব করা। যদিও দূরত্বের হিসেবটাও রয়েছে স্ক্রিনে। একবার তো কয়েক'শো কিলোমিটার কম বেরোলো। একটু অস্থির হয়ে পড়লেন। কয়েক মুহূর্ত পরে গুই (গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস) রিফ্রেশ হতেই সব হিসেব মিলে গেল, আর মাছের-ওজন-কম-ধরতে-পারা আনন্দে নুপ কাকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বিড়বিড় করে বললেন, পথে এসো বাবা।
পাইলটকে উদ্দেশ্য করেই বললেন হয়তো।

আমি একটা মেন্টাল নোট নিলাম। অত্যাধুনিক প্লেনে এ ধরনের রিভার্স কম্যুনিকেশনের বিলক্ষণ প্রয়োজন রয়েছে। বেচারা পাইলটের তো জানা দরকার, লোকে শুধু গবগব করে চিকেন স্যালাড খেতে খেতে সিনেমা দেখে না, রিয়েল টাইম কড়া রিভিউ হয় রীতিমত।

ব্যাক টু প্রেজেন্ট টেন্স। এখন অবশ্য নুপ কাকুর চোখের ভাষা পড়ে নিতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না।
আমার তো মোটে একটা টি শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার। তাতে তো জ্যাকেটের জিপার দেওয়া পকেটের নিশ্চিন্ত আশ্রয় নেই। ‘হার্ড’ ড্রিঙ্ক্‌স আমি নিলাম কোথায়? র‍্যাদার, লুকোলাম কোথায়?

কাকুকে নিশ্চিন্ত করতে ব্যাখ্যা করতেই হল, মোটে চার লিটার সোমরস নিয়েছি, নিচে নেমে সহযাত্রী কোলিগের ঘাড় দিয়ে চালাবো বাকি দু লিটার। আমার মদ্যপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে মদ কোম্পানি একটা ট্রলি ব্যাগে যত্ন করে সব বোতল ভরে দিয়েছেন।
কাকুর মুখে প্রশংসাসূচক হাসি ভেসে উঠতেই টের পেলাম, পাস মার্ক্স পেয়ে গেছি। হয়তো বা ডিস্টিঙ্কশন’ও।

আসলে, জানো তো বন্ধুদের দেখাবো বলে, নিয়ে নিলাম।
সে বেশ করেছেন, কিন্তু প্লেনের মধ্যে একটা ড্রিঙ্ক নিলেন না কেন? আমি তো ভাবছিলাম একসাথে চিয়ার্স করবো।

না, আসলে আমি ভাবছিলাম সবাইকে একটা করেই বোতল দেবে ... কিন্তু তারপর দেখলাম ... এই তো তুমিই দুটো নিয়েছো। ওই সামনের সিটে ডানদিকে একজন চারটে নিয়েছে। আমি আসলে ...

ঠিক আছে, এখন একটা নিয়ে নিন।
চলে গেল যে? আবার ডাকবো? সিট বেল্টে হাত দিয়ে কেবিনের পেছন দিকে তাকালেন নুপ কাকু।

কোনো ব্যাপার’ই না, এই সুইচটা টিপলেই ওরা এসে খোঁজ করবে। সামনের ডিসপ্লের অসম্ভব জটিল ড্যাশ বোর্ডের মধ্যে থেকে সুইচটা খুঁজে বার করে, আপনার-সহযাত্রী-সব-জানে মুখ করে কাকুর দিকে তাকালাম।
না থাক।

এখন আর খাবো না।

প্লেন ইন্ডিয়া ঢুকে পড়েছে, সাহেবী ভদ্রতার আর প্রয়োজন নেই, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, সে কি? কেন?
না মানে ইয়ে ... তোমার ... মাসীমা। একসাথে সিট পাই নি। ওই পিছনের সিটে, এখনও জেগে আছে। বেশী রাত করে হার্ড ড্রিংক করলে ... আবার ...

বুঝেছি। ছেলে-মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছিলেন?

না, আমরা সবাই আলিপুর থেকে বেড়াতে এসেছি। মোট পঁয়ত্রিশ জন। কক্স অ্যান্ড কিংস। ইওরোপ ট্রিপ। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল। তো বেরিয়ে পড়লাম দু’জন মিলে।

কোথায় কোথায় গেলেন?
প্লেনে করে লন্ডন গেলাম। সেখানে দুদিন ছিলাম। তারপর সেখান থেকে বাসে করে প্যারিস, ওখানেও দুদিন। সেখান থেকে জেনেভা, তারপর ইটালি, মানে রোম। বেশ ভালো ঘুরিয়েছে। গাইড দিয়েছিল সঙ্গে। ভালো গাইড, হিন্দীতে কথা বলছিল।

কেমন ঘুরলেন?
বেশ ভালো। ঘুরলাম, খাওয়া দাওয়া বেশ ভালো ছিল। ব্রেকফাস্ট, কন্টিনেন্টাল ডিনার। মানে বেশ বাঙালি খাবার, চিকেন, ভাত। লাঞ্চটা অবশ্য নিজের। ওটায় একটু খরচা হয়ে গেল। তা হোক, অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল জানো, ইওরোপে ঘুরতে যাবো। ওরা আমাদের দেশে আসে, স্প্ল্যানেডে তো প্রায়ই দেখি ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেতে পারি না? তো এবার জানুয়ারিতে একটা এফ ডি ম্যাচিওর করলো, আমি গিন্নীকে বল্লুম, চলো – বয়েস হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে, আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না। তোমার মাসীমা অবশ্য গাঁইগুঁই করছিল, শাড়ি পড়তে দেবে কিনা।

আরে সে রকম গাদা গাদা ছবি তো ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাবেন।
না আমি ইন্টারনেট’টা ঠিক ... আমাদের সময় আসলে ওসব ... তবে ট্রাভেল এজেন্টের ব্রোশিয়োরে একটা ছবি ছিল। সেটা দেখিয়েই রাজী করালাম। চল্লিশ বছর ধরে চিনি তো ওকে। নইলে আসত’ই না। আর ওকে ছাড়া কখনও ...... মানে বাইরে ...


বুঝেছি।

--

কলকাতায় নেমে ই-বোলার ফর্ম ভরে, ইমিগ্রেশনের খেঁকুটে ভদ্রলোকের সামনে যাওয়ার আগে কি মনে হল, ঘুরে তাকালাম।
ওই তো কাকু দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনের পরে। সাথে মাসীমা।

আসি কাকু, পরের বার কিন্তু একসাথে চিয়ার্স করব।
ভালো থেকো বাবা। আবার দেখা হবে।

কলকাতায় নেমে গেছি। বাংলা কথা শুনতে আর কান খাড়া করে বসে থাকতে হবে না। কিন্তু তাও আরো একবার ঘুরে তাকাতেই হল। ওই তো নুপ কাকু তাকিয়ে আছেন, উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, ততোধিক উজ্জ্বল একমুখ হাসি। নুয়ে পড়া দেহ থেকে একরাশ ভালোবাসা বেরিয়ে আসছে।

কি দরকার ছিল নুপ কাকুর এই কথাটা বলার। আমি-উনি দুজনেই তো খুব ভালো করে জানি আর কোনোদিনই দেখা হবে না। কি করে হবে?

এতো মানুষ, এতো কথা।

“কিছুই তো আর যায় না শোনা, কার কথা কে বুঝবে বল/
বুঝতে হলে কথার মানে, চেনা পথের বাইরে চল।
তবুও কিছু যায় না বলা, শব্দ খেলায় কেবল ফাঁকি/
কথার পিঠে কথা সাজাই, আমরা এখন একলা থাকি।।”

(চলিবে, লেখার শিরোনাম খুব সম্ভবত মিসলিডিং - আমার বস্টন ট্রিপের ট্রাভেলগ)

8 comments:

  1. Replies
    1. একদম, এক্কেবারে টু। নুপ কাকুরা এরকম ভালোই হন।

      Delete
  2. খুব মায়াময়… নরম অথচ কৌতুকদীপ্ত লেখা।
    পড়তে পড়তে অনেককাল আগের মানে আমাদের সময়ের প্রচলিত দু'লাইন মনে পড়ল।

    সে'দিনের সেই ছেলে ঢুকঢুক পিও !
    যাই হোক, জিও বাছা… যুগ যুগ জিও ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই, সেদিনের বাচ্চা, আজকের বুড়ো।

      Delete
  3. খুব ভালো লাগলো রে লেখাটা। কিছুই সেরম না, কোনো বড় ঘটনাও নেই কিন্তু পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যিই বড় কোনো ঘটনা নয়, কিন্তু মনে থেকে যায়। প্রথম বার আমেরিকা গেলুম, আর এই ঘটনা টাই প্রথমে লিখতে ইছহে করলো।

      Delete
  4. Last er kobita tar jonno amar torof theke ek glass scotch...jedin ichche redeem kore niyo

    ReplyDelete
    Replies
    1. ota kintu amar lekha noy, tai quotation er modhye.. gan ta ekhane..Amaar Kichu Katha Chilo - Moushumi Bhowmik: http://youtu.be/kvs4G_SSzGM

      Delete