Saturday, October 25, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ: "সি ফুড"

দেখুন স্যর, ট্রাভেলগ তো অনেক পড়েছেন। ছাপা, বাঁধানো, সুন্দর সুন্দর ছবি দেওয়া। আপনার জন্য আমাদের ব্লগ কোম্পানি বিনে পয়সায় এই ট্রাভে-ব্লগের ব্যবস্থা করেছে।

ইন্টারনেটে রোজ'ই তো কত্ত কিছু পড়েন। আমার এই পাতা নেক্সট্‌ ক্লিকেই চোখের সামনে থেকে উড়ে যাবে।

পড়া না পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু একটু পল্লবগ্রাহিতা তো করে দেখুন।

কারেকশনঃ আগের প্যারায় যা লিখেছি, দয়া করে ভুলে যান। পড়া না পড়া আপনার নয়, বেশ কিছু দিন হল আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস, খারাপ মানুষ তো বিশেষ করে। সুতরাং ব্লগ পড়ে আপনাদের কেমন লাগলো সেটা না জানালে, আকুপাকু অবস্থা এবং শেষমেষ আকুপাংচার।

ট্রাভেলগ হওয়ার কথা ছিল বোস্টনের, কিন্তু এখনও দেশ ছেড়ে বেরোনো হয় নি। নিজগুণে ক্ষমা করবেন, প্লিজ।

আর হ্যাঁ, প্রথম আর দ্বিতীয় সংখ্যা এখানে রইলো। যেহেতু আমরা কোন নির্দিষ্ট টাইমলাইন অনুসরণ করছি না, এখন থেকে শিরোনামে সেই পর্বের কোন ক্যাচলাইন দেওয়া থাকবে।

হ্যাঁ, এই আইডিয়া'টা ফ্রেন্ডস থেকে বেমালুম ঝাড়া।
--

আপনি কি সি ফুড খান?

মানে দায়ে পড়ে খান, না ভালোবেসে খান? যদি ভালোবেসে খান, তাহলে একটা গায়ে পড়ে সাজেশন - ইন্ট্যারন্যাশনাল ফ্লাইটে চাপবার অন্তত একদিন আগে আপনার পছন্দটা প্লেন কোম্পানিকে জানিয়ে দিন।

কেন?

উহু, কারণ টা শুধুই চিংড়ি বা টুনা অথবা স্যালমন প্রেম নয়। আসল কারণ হল গিয়ে লোভ।

পুরোদস্তুর হ্যাংলামো।

এয়ারহোস্টেস মহোদয়া যবে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আপনার কাছে আসবেন, গড়পড়তা পঞ্চাশ জন ততক্ষণে খাবার খুলে ফেলেছেন। প্রথম রো'তে অনেকেই ততক্ষণে ঢেঁকুর তুলতে শুরু করেছেন। আপনার পাকস্থলীতে অভ্রান্ত নিশানায় সুগন্ধের কার্পেট বম্বিং শুরু হয়েছে

কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।

যদি না আপনি আগে থেকে স্পেশাল অর্থাৎ কিনা স্বাভাবিক নয় এরকম কিছু অর্ডার করে রাখেন।

অস্বাভাবিক খাবারের লিস্টি অবশ্য ছোট নয়। হিন্দু মিল, মুসলিম মিল, সি ফুড, জৈন মিল ইত্যাদি ইত্যাদি।

জুরিখ থেকে দুবাই এর ফ্লাইট পাকড়ানোর আগে বন্ধু -কাম-ভাই-কাম-অঙ্কের-গবেষক একজন'কে একবার এই সেম জ্ঞান পাস করেছিলাম। ছেলে বুদ্ধিমান এবং এক্সপেরিমেন্টাল, এবং জাজমেন্টাল।

আচ্ছা, হিন্দু মিল নয় কেন?

প্লেন কোম্পানি হিন্দুমাত্রেই শাকাহারী ধরে নেয়, তারপর লাঞ্চ বক্সটা কালাহারি'র মত ধু ধু করে কিনা, তাই।

হুম, তাইলে মুসলিম মিল কি দোষ করল?

এবার আমার মাথা চুলকানোর পালা। ইয়ে, না মানে দোষ কিছুই নয়। আসলে যাবতীয় ধর্মীয় ব্যাপার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখাটাই আমার মতে সেফ এন্ড সিকিওর।

একদম ডাহা মিথ্যে কথা। খাওয়ার জন্য এ শর্মা অনেক নিচে নামতে পারে, ধর্ম ইনক্লুডেড।  মাস্টার ডিগ্রী পড়াকালীন পরবাসী শিক্ষার নিয়ম মেনে দিনের দিনের নিজেকে রান্না বান্না করেই খেতে হত। বাংলার মাস্টারমশাই কে মনে পড়ত, অদ্যভক্ষ ধনুর্গুণ কথাটার মানে হাড়ে হাড়ে টের পেতাম। তাই সুযোগ পেলেই ধর্মীয় স্থানে গিয়ে চারটি খেয়ে আসতাম।

চার্চ, মন্দির, মসজিদ সর্বত্রই। পাপী তাপীদের কোনো স্থিরতা থাকে না।
নেহাত আমি যে শহরে থাকতাম সেখানে গুরদোয়ারা ছিল না তাই।

মন্দিরে মিষ্টি, ফল।
চার্চে কেক, ফল।
একমাত্র মসজিদ’ই আমার টেনাসিটির মান রাখতো - ভেজ পিৎজা।

ইতালির গা ঘেঁষা সেই সুইস শহরে বেগুন বা ফুংগি (মাশরুম) পিৎজার স্বাদ'ই আলাদা। বাংলাদেশী অথবা নিদেনপক্ষে ওদেশী বাড়িতে পাত পেড়ে সর্ষে ইলিশের মত। অথেন্টিক এবং রিলায়েব্‌ল।

তো স্বভাবতই প্লেন কোম্পানির ঘোষিত মুসলিম ফুড খারাপ হওয়ার কথা নয়। সুতরাং মুসলিম মিল ট্রাই করা যেতেই পারে, ইন ফ্যাক্ট ট্রাই করা উচিত।

সেইমত সিলেক্ট করা হল। আমি সি ফুড, বন্ধু মুসলিম ফুড।

অবশেষে শুভযাত্রার দিন এল। প্লেনে চাপলুম, খানিক এদিক ওদিক করার পরে প্লেন যখন গোঁত্তা খেয়ে পূবে বাঁক নীল আর জুরিখ লেকের শেষটা মিলিয়ে গেল, বিমানসেবিকা আসলেন।

সি ফুড স্যার?

ইয়েস প্লিজ।

মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো তো। প্রতিবার ভাবি এতবার যাচ্ছি, এবার নিশ্চয়ই লবস্টার আর ক্যাভিয়ার দেবে। যথারীতি টুনা পড়েছে কপালে, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের ইকনমি ক্লাসে এর চেয়ে বেশী আতিথেয়তা জুটবে না।



আশেপাশের সিটে একটু আলোড়ন উঠলো। আমাদের লাইন ভেঙ্গে খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা।

কিছুক্ষণ পরে আমার বন্ধুর সামনে এসে, রক্তকেশী - এন্ড ফর ইউ স্যার, ইজ ইট মুসলিম মিল?

হ্যাঁ।

আমরা দুজনেই সাগ্রহে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত কষ্ট করে, অবিকল অধুনা লুপ্তপ্রায় অজন্তা সার্কাসের সুন্দরী ট্রাপিজ নর্তকীর মত, নয়নাভিরাম ব্যাল্যান্স করতে করতে, একটা স্ট্যান্ডার্ড প্লেটে, অসম্ভব বিশাল মুর্গীর গোটা রোস্ট ও তৎসহযোগে বিড়াল-না-ডিঙ্গাতে-পারা ভাত, রুটি, কাবাব ইত্যাদি উপুড় করে দিলেন। একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এই পরিমাণ খাওয়া অসম্ভব। বাজী রেখেও নয়।

মুসলিম ফুডের বদান্যতায় আমি আপ্লুত। অভিভূত।

আমার বন্ধুটি আবেগতাড়িত হয়ে যেই না মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, বাব্বা, সো মাচ ফুড। ট্রাপিজ নর্তকী থুড়ি বিমানসেবিকা মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, এমিরেট্‌স অলওয়েজ টেকস্ কেয়ার অফ ইয়োর স্পেশাল নিড, স্যর। সিন্স ইউ ফাস্টেড ফর দ্য লাস্ট সিক্সটিন আওয়ারস, প্লিজ কন্সিডার দিস ……

ফাস্ট??
কে করেছে?
কবে?
কোথায়? কেন

বললাম না বরাবর’ই ধর্মীয় ব্যাপার স্যাপার থেকে দূরে থাকি। তাহলে ফাস্টের প্রসঙ্গ আসছে কেন?
এয়ারপোর্টে চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় কিছুই বাদ দিই নি। দু’জনেই। এবং সেটা রীতিমত বিগত ষোলো ঘন্টার মধ্যেই হয়েছে।

হঠাৎ জটায়ু - হাজার ভোল্টের স্পার্ক। ও হো, এ তো রমজান মাস।
একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম যে প্লেনে অব্দি মুসলিম মিল ছাড়া খায় না, তার তো এটুকু যত্ন প্রাপ্য। সারা দিন উপবাসে রয়েছে বেচারা।

উজ্‌ ইউ লাইক টু হ্যাভ এনি ড্রিংক স্যার?

বন্ধুবর খাবারের বিশাল প্লেটের দিকে তখনও হিপ্নোটাইজ্‌ড হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।

এক্সকিউজ মি স্যর, হুইচ ড্রিংক ফর ইউ?

হুইস্কি প্লিজ। ওনলি সোডা, নো ওয়াটার।

অনেক অন্যান্য অনুভূতির মতোই চমক সাধারণত একদিকে হয় না। ব্যাপারটা হাই তোলার মত, ছোঁয়াচে। যত পরেই হোক, আসবেই আসবে।

যে শান্ত বিমানসেবিকা দু'কিলোর ডিনার সরবরাহ করে আমাদের যারপরনাই চমকে দিয়েছিলেন, তিনিই এবার হাঁ। আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন, ডিড ইউ সে হুইস্কি স্যার?

বন্ধু কনফিডেন্ট। ইয়েস প্লিজ।

যে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মানুষটি প্লেনে ওঠার আগে মুসলিম মিল অর্ডার করতে ভোলেন নি, তাকে সুরা সার্ভ করতে ভদ্রমহিলার একটু বাধো বাধো ঠেকছিল।

ভ্রাতৃপ্রতিম ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, কি অনির্বাণ’দা? কেমন হল?

প্লিজ হাত লাগাও। গোটা মুর্গী সাবাড় করা আমার কম্মো নয়। যাইহোক খাবারটা একঘর দিয়েছে, কি বলো? এরপর থেকে তো তুমি সি ফুড ছেড়ে মুসলিম মিলের দিকে ঝুঁকবে?

নাহ্‌ ভাই আমি ঝুঁকি নিয়ে ঝুঁকতে পারবো না রে। আমার সি ফুড বেঁচে থাক।

কেন? সি ফুড কেন? ঝুঁকি কিসের?

কারণ, নাই মামার থেকে কানা মামা ভাল।

মানে?

মানে এটা ডিনার বলে ডবল খাবার পেলি। লাঞ্চ হলে?

এক গ্লাস জল জুটত, টেনেটুনে জুস।
--

কিছুদিন আগে ব্লগ অ্যানালিটিক্স সংক্রান্ত একটি জ্ঞানের লেখা পড়লাম - তাঁরা বলেছেন, পাঠক’কে যদি আপনি গঁদের আঠা ছেড়ে ফেভিকলের আঠা ধরাতে চান তাহলে মিনিমাম একটা শব্দসংখ্যার লেখা লিখতেই হবে। তাঁর থেকে কম - নৈব নৈব চ।

ফেভিকল’কে ফেভি কুইকে পরিণত করতে গেলে নিয়মিত লিখতে হবে। পাঠককে আমি আছি, আমি আছি।

মোদ্দা কথা পোচ্চুর পরিশ্রম করতে হবে। অতএব এখানে শেষ না করে হাজার শব্দ অতিক্রম করতে চাইছি। আটখানা গানেও ফিতে না ভরলে যেমন টেপের শেষে ফিলার থাকতো, এবং অনেক ভালো জিনিষের মতোই প্রযুক্তি যাকে কেড়ে নিয়েছে, সেই ফিলারের শরণাপন্ন হলাম।
--

প্রায় সব ভারতীয় বিদেশযাত্রার সময়ে, লাগেজে করে প্রচুর ভারতীয় খাবার বিদেশে নিয়ে যান - এই ধরণের খাবারের রেঞ্জ অসামান্য - রাহুল দ্রাবিড়ের তূণেও এর থেকে কম শট আছে। মুড়ি, ম্যাগি, মিষ্টি থেকে শুরু করে হলুদ, লঙ্কাগুঁড়ো, তেজপাতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার ব্যাগে যেমন থাকতো ইঁটের মতো শক্ত ফ্রজেন, লোটে মাছের ঝুরা। যারা জানেন না, তাদেরকে আমি জানাতে চাই না, কারণ ওপরের সিক্রেটের মত এটাও ফাঁস হয়ে গেলে মুশকিল।

মাছ’টা তাহলে আর পঞ্চাশ টাকা কিলো থাকবে না।

তো এরকম আমার দুই বন্ধু শর্ট টার্ম ট্রিপে আম্রিকা গেছে। একজন সিনিয়র, একজন জুনিয়র। বয়েসের পার্থক্য প্রায় দশ বছর। দুজনেই পাঁচ কিলো করে বিস্কুট নিয়েছে। প্ল্যান পাকাপোক্ত।

ট্রানজিট এয়ারপোর্টে পৌঁছে বড় বন্ধু ছোট বন্ধুর কাছে বিস্কুট চাইল।
ক্যারি-অন লাগেজ থেকে বিস্কুট বার করতে করতে অত্যন্ত বিরক্ত  মুখে ছোট বন্ধু বলল,

কলকাতায় তখন পইপই করে বললাম, পুরো বিস্কুট’টা চেক-ইন লাগেজে ঢুকিয়ো না। এবার বোঝো। শিকাগো আসার আগেই বিস্কুট ফুরিয়ে গেলে খাবেটা কি?
— 

কথা দিচ্ছি, এর পরের সংখ্যাতেই আমরা বোস্টন ছোঁব।
অবশ্য আপনারা হলেন কিনা প্রিয় পাঠক, আমি ভুল করলেও আপনারা মানিয়ে নেবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে।
ষোলো আনা।

Friday, October 17, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ (দ্বিতীয় পর্ব)

খুব এলোমেলো একটা ট্রাভেলগ হচ্ছে, যেটা প্রথমে মনে পড়ছে, সেটাই প্রথমে লিখে ফেলছি। কোন ক্রনোলজিক্যাল অর্ডার মানছি না। প্রথম পর্ব মোট চারজন পড়েছে, তারমধ্যে আমি একজন। আপনি যদি নতুন পাঠক হন, তাহলে জানাবেন কেমন লাগলো, পুরনো পাঠক হলে তো কথাই নেই।
--

আমেরিকা থুড়ি আম্রিকা হচ্ছে স্বপ্নের জায়গা - এটা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে। আপনি অলরেডি সত্যিটা জেনে থাকলে তো ভালোই, নইলে এই বেলা জেনে নিন। মেনেও নিন, নইলে পস্তাবেন।

পস্তেছি তাই বলছি।

কিভাবে?
আমার এক জুনিয়র সহকর্মী (সহকর্মিনী কথাটা কি ঠিক?) যেদিন শুনলো আমায় ভিসার জন্য ইউ এস এম্ব্যাসী যেতে হবে, আরো অনেকের মত আমার পাসপোর্টে দশ বছরের ছাপ নেই, সেদিনকেই বেচারির ভ্রুজোড়া কুচকে গেসলো। 

মেয়েটি ইউ এস এ নিয়ে একটু অবসেসড। 
সেখানেই ভবিষ্যতে থাকবে, বুড়ো হবে, মারা যাবে - এইরকম সহজ সরল প্ল্যান। ইন ফ্যাক্ট, আমার পচা গলা মনের দৃঢ় বিশ্বাস - চেনা জানা আরো অনেকের মনের মধ্যেই এই একি স্বপ্ন দিন রাত চলেছে, এই মেয়েটির অন্তত: সাহস রয়েছে নিজের স্বপ্নটা খোলা গলায় সবাইকে জানানোর।

কিন্তু আমি সেই স্বপ্নভঙ্গ করলাম।
যখন কথাবার্তায় বেরোল, এইটেই আমার প্রথম ইউ এস ট্রিপ (হলেও হতে পারে, তখন ও ভিসা ইন্টারভিউ হয় নি), সেই কোলিগ আমার দিকে চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।



একজন একত্রিশ পেরোনো ইঞ্জিনীয়র, যে নিজেকে মোটামুটি শিক্ষিত বলে দাবি করে, অফিসের জনশ্রুতি অনুযায়ী গত আট বছর ধরে বিদেশে চক্কর মেরেছে, পড়েছে, পড়িয়েছে, চাকরি করেছে, জ্ঞান দিয়েছে এবং প্রচুর জ্ঞান শুনেছে - সে ইউ এস কখন ও যায় নি? 

হোয়াট দ্য হেল? ইজ ইট পসিবল ইভেন প্লজিবল টু এনিওয়ান?

সেই তীব্র হতাশা মাখা মুখ আমি ভুলবো না।

অবশ্য হতাশার তখনো ঢের বাকি ছিল। সকাল সাতটায় ইউ এস এম্ব্যাসি যেতে হবে। শোফার নেই আমার, তাই সেল্ফ ড্রাইভ। তবে একা নয়। টমটম ও নেই আমার, সেই কাজটা হাসিমুখে সোহিনী করে থাকে। আমার স্ত্রী।

দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌছে বার দুয়েক গোল গোল হয়ে একইরাস্তায় বার দুয়েক চক্কর মারার পর যখন কমলেশ্বরের আলভারেজের মতন নেক্সট ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দিগনির্ণায়ক কিছু ফিট করা যায় কিনা ভাবছি, ঠিক তখন ই সোহিনী বল্লো গাড়ি পার্ক করে আগে কিছু খেয়ে নিই চলো।

আমাকে যারা বিন্দুমাত্র চেনেন, অথবা চেনেন না, তারাও সম্ভবত জানেন, আমি অত্যন্ত লোভী প্রকৃতির মানুষ। এ ধরণের প্রস্তাবে আমায় পেড়ে ফেলা খুব সহজ। সেই ছোটবেলাতেও শুনতাম ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, অচেনা কেউ কিছু খেতে দিলে খাবে না। শুধু খাওয়াতেই নিষেধাজ্ঞা। কেউ কোনোদিন বলে নি অচেনা কারুর সাথে কোথাও চলে যেও না, জানা ছিল ইন্সেন্টিভ অফার না করলে সে গুড়ে বালি।

কোথায় গাড়ি পার্ক করব বল তো?
এই তো ওই খানে, পুরির দোকানের পাশে।

এটা তো ক্যামাক স্ট্রীট - কলকাতার রাস্তাঘাটে পার্কিং নিয়ে আমার বিলক্ষণ ভয় আছে।
ত্তুর, রাখোতো। সকাল সাড়ে সাত'টা, কেউ নেই। পার্কিং শিওর আলাউড।

কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পুরি তরকারি সাটানো হল। তারপর দোকানী কে এম্বেসীর পথ জিজ্ঞেস করতে, সে জানালো,

সোজা নাক বরাবর হাটতে থাকুন। বাদিকে চোখ রাখবেন। যেখানে দেখবেন কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ বসে জটলা করছে, ওই বাড়িটায় ঢুকে পড়বেন।

এইরকম সহজ এফেক্টিভ গাইডেন্স একমাত্র চাঁদের পাহাড়ে কমলেশ্বর'ই দিতে পেরেছেন। কখন বুঝবেন 'বই'টা শেষ হচ্ছে? রজতাভ থুড়ি বুনিপ পটকে গেলে? উহু একি বাজারি সিনেমা পেয়েছেন নাকি? যখন দেখবেন দেবের মুখমন্ডল শ্মশ্রুশোভিত - তখনি বুঝে নিতে হবে এই হয়ে এসেছে, নেক্সট ক্লিন শেভেই সিনেমা খতম।

চাঁদের পাহাড় নিয়ে আমার প্রচুর বক্তব্য আছে, মানে কমলেশ্বরের চাঁদের পাহাড় নিয়ে। এই পোস্টে সেদিকে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। শুধু এটুকু বলা যায়, মানিকবাবুর গণশত্রুর সেটে চাঁদের পাহাড় বানালে আর মগনলালকে বুনিপের পার্ট দিলেও এর থেকে ঢের বেশী জমত। অবশ্য মানিকবাবুর কাছে বাংলা সিনেমা ঠিক যতটা ঋণী, পারিবারিকভাবে তার থেকে একটু বেশীই উশুল করে নিচ্ছেন তাঁরা। প্রথমে ভয়ঙ্করী আমাদের কথা, ফলোড বাই একের পর এক ফেলুদার গল্পের হাড়িকাঠত্ব বরণ।

শেষ শুটিং হচ্ছে শুনলাম বাদশাহী আংটি।

জটায়ুর লেখাগুলো অপ্রকাশিত অবস্থায় আ বা প র কাছে সন্তোষ দত্ত রেখে যান নি? তাইলে তো অন্তত জটায়ুকে বেচে ফেলুদা বেঁচে যেত। একটা অবিবাহিত আপাদমস্তক ভালো লোকের এরকম অপমৃত্যু মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

ব্যাক টু কলকাতা ইউ এস এম্ব্যাসি। সকাল সাড়ে সাতটা।

ভালো ইলিশ মাছ বেশী পরিমাণে উঠলে, কিলো প্রতি দর যখন তিনশো টাকায় নেমে যায়, তখন মফস্বলের মাছের বাজারে কিরকম ভিড় হয় দেখেছেন নিশ্চয়ই।

সেম জিনিস।

শুধু এরকম রোয়াব দু কেজি ইলিশের মাছ ওলার ও থাকে না। দোকানের বাইরে ক্রেতারা সব্বাই চুপটি করে, ভদ্র হয়ে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। সকলের হাতে বা বগলে ফাইল। কারুর মোটা ফাইল, কারোর সরু ফাইল, কারোর কারোর ভীষণ মোটা ফাইল। আমার সামনের ভদ্রলোক বিশাল কাগজের স্তুপ নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল ভিসা ইন্টারভিউ এর পরেই বোধহয় পুরোনো কাগজপত্র কিনে নেওয়ার বন্দোবস্ত থাকে, আর সেটা নিশ্চয় ডলারে। নইলে সাতসকালে কেউ স্বেচ্ছায় অত ভারী কাগজের বান্ডিল নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে পারে না।

সেই ভুল ভাংলো যখন মৃদু হাওয়ায় দুটো পাতা বান্ডিল থেকে খসে পড়লো। ভদ্রলোকের গত বছরের বাড়ি ভাড়ার রসিদ।

আমি নিশ্চিত আর একটু হাওয়া দিলেই কে সি পালের ছাতার বিলটাও বেরোত।

তাপ্পর মিনিট কুড়ি লাইন দিয়ে অবশেষে যখন ফুটপাত থেকে প্রথম গেট'টা টপকালাম, সামনের স্ক্যানারে সেই ভদ্রলোকের কে সি পালের কালো ছাতা ধরা পড়েছে। কালোটা সমস্যা নয়, ইউ এস এম্ব্যাসির ওরকম হাজারো কালো পতাকা দেখে অভ্যেস আছে। সমস্যা হচ্ছে ছাতার মেটালিক অংশ। স্ক্যানার কে সি পাল'কে মেনে নিতে রাজি।নয়, প্রবল বেগে ট্যাঁ ট্যাঁ করে আওয়াজ করছে। ভদ্রলোক মিনমিন করে সিকিউরিটিকে বোঝাচ্ছেন। সিকিউরিটি বেচারার বোঝার কিছু নেই, অসময়ের পুজোর বৃষ্টি কি শুধু কবিরাই টের পান? কিন্তু তার হাত পা বাধা। বড় সাহেব বারণ করেছেন।

স্ক্যানার পেরিয়ে আমার চোখ খুলে গেল। প্রথম বার ইউ এম্ব্যাসির কার্যকলাপ নিয়ে ধ্যান ধারণার সামান্য উন্নতি হল। ব্যাটারা মাল্টিপল বাফার লাগিয়ে ওয়েটিং টাইম এবং বিরক্তি দুটোই কমিয়েছে।

ফুটপাতে ভিসা প্রত্যাশীর সংখ্যা আদপে কিছুই নয়, ক্যাম্পাসের ভিতরে একদম মেলা দিলো কা আতা হ্যায়। শুধু আমীর খানের জায়গায় সুবেশী মার্কিন অ্যাক্সেন্টের তরুণী। ইংরিজীতেই বলছেন, তবে কিনা পাত্র ও পাত্রী বিশেষে বাংলা, মায় রাষ্ট্রভাষা অব্দি বলতে হচ্ছে। বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত। প্রবল জ্ঞানপিপাসু। কেন একজন আলিয়েন ইউ এস এ যেতে চাইছেন, তা নিয়েই ওনার থীসিস।
এই আলিয়েন ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই বেশ জ্বলে ছিল আমার। ইউ এস এরর রেসিডেন্ট না হলেই আপনি এলিয়েন। ফর্মে অন্তত তাই লেখা ছিল। ভীষণ যন্ত্রণার ঘটনা।

যাজ্ঞে, সে বাধা টপকানো গেলো। কাগজপত্র ও মুখের ভাষা ঠিক থাকলে ব্যাপারটা অত জটিল নয়। এই ঘরে অপেক্ষা করতে করতে ভিসাপ্রার্থী যাতে বোর না হন সেই কারণে প্রচুর বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে। সব কটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন। রিসর্ট, র‍্যাঞ্চ, ঘর-বাড়ি, চাকরি - কিচ্ছুটি নয়, শুদ্ধু গ্র‍্যাজুয়েট ডিগ্রী। একদম কাস্টমার সেন্ট্রিক ফোকাসড আড। শেষ মুহূর্তে আপনি যদি ক ইউনিভার্সিটি থেকে খ ইউনিভার্সিটিতে লাফ মারতে চান। খ'তে মাঠ'টা বড়ো, পাশে নদী আছে - আর একটা নোবেল আছে।

বলা তো যায় না মানুষের মন বলে কথা।

এরপর আপনি এসে দাঁড়ালেন দিনের তৃতীয় সারিতে। এখানে একটা মক ইন্টারভিউ গোছের হচ্ছে। কাউন্টারে ডেকে নামধাম, ডেসিগনেশন জিজ্ঞেস করে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। নমুনা এরকম।

আপনার নাম কি?
মগনলাল মেঘরাজ।

আপনার পদবী কি?
আজ্ঞে, মেঘরাজ।

কিন্তু আপনার পাসপোর্ট তো তা বলছে না।
মগনলালের চোখে একরাশ অবিশ্বাস।

আপনার পাসপোর্টে লেখা আছে আপনার নাম মগনলাল মেঘরাজ, আর আপনার কোনো পদবী নেই।
মগনলাল চুপ।

অথচ আপনার ব্যান্ক আকাউন্ট অন্য কথা বলছে। সেখাবে আপনার পদবী মেঘরাজ। কোনটা সত্যি মগনলাল?
কানের পাশ দিয়ে গুনে গুনে ছটা গুলি চলে গেছে, মগনলাল আর বিশেষ  কিছু বলার অবস্থায় নেই।

আরেক কাউন্টারে আরেক ফ্লেভারের নামসংকীর্তন হচ্ছে।

আপনার নাম?
জয়া বচ্চন।

নাম?
জয়া।

পদবী?
বচ্চন।

আপনার ভোটার আই ডি কার্ড তো সেকথা বলছে না জয়া। সেই ডকুমেন্ট অনুযায়ী আপনার নাম জয়া ভাদুড়ী।
না মানে, ওটা আমার বিয়ের আগের নাম।
 
আপনার কি উচিত ছিল না বিয়ের পরে সমস্ত ডকুমেন্টে আপনার নাম'টা ঠিক করিয়ে নেওয়া?

এবার পাশ থেকে অমিতাভ টুকি দিলেন। 
হেঁই ... সরি ... এজ্ঞে ম্যাডাম, প্যান কার্ডে দেখুন জয়া বচ্চন করা আছে, ভোটার কার্ডে চেঞ্জ করা প্রচন্ড হ্যাপা। ইটস এ লেংদি প্রসেস।
মি: বচ্চন, আপনার স্ত্রী যদি নিজের নামটাও সমস্ত ডকুমেন্টে ঠিক করে দেখাতে না পারেন তাহলে উনি বিদেশে গিয়ে থাকবেন কি করে? আপনাকে ছাড়া যদি উনি চলাফেরা করতে না পারেন তাহলে তো ওনার দেশের বাইরে যাওয়া কাম্য নয়।

ইতিমধ্যে জয়ার কোলে অভিষেক কাঁদতে শুরু করেছে। অদ্ভুত সময়জ্ঞান। নাইন্টিজের সচিন-সৌরভের মত।
না বাবা না, তুমি লক্ষী হয়ে থাকো, কার্তিক হয়ো না।

নাম ধাম সমস্ত ম্যাচ করে যাওয়ায় তৃতীয় লাইনেও বিশেষ অসুবিধে হল না। এইবার আসল পরীক্ষা। চতুর্থ তথা অন্তিম সারি।
এখানে রিপ্লাই বাইনারি। হয় ভিসা হবে, নইলে নয়। মাধ্যমিক থেকে ইংজিনিয়ারিং - যেভাবে সবাই আগের পরীক্ষার্থীর প্রশ্ন শুনে নেয় - সে ভাবে শুনতে থাকলাম। কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন? কবে ফিরবেন? আদৌ ফিরবেন কি? ইত্যাদি...

সমস্ত উত্তর তৈরী। কিন্তু ওই যে পরীক্ষক আস্তিনের তলা থেকে বরাবর ক্ষেপনাস্ত্র বার করেন, তার অন্যথা হল না।

আপনার পাসপোর্টের পাতাগুলো এরকম ফিকে লাল কেন?
বছর পাঁচেক আগে মিলান এয়ারপোর্টে হঠাত বৃষ্টি নেমে বুক পকেট সুদ্ধ ভিজিয়ে দিয়েছিল, তাই। অনেক চেষ্টা করেও কলকাতা ইমিগ্রেশনের লাল স্ট্যাম্প থেকে কালি লিক করা আটকাতে পারি নি, তাই।

হুম, আপনি কদ্দিন ইউ এস এ থাকবেন?
আজ্ঞে, আটদিন মোটে।

এর আগে, ইউরোপে দেখছি আপনি ছয় বছর ছিলেন, চলে এলেন কেন?
বলতে ইচ্ছে করছিল, বেশ করেছি। 
বললাম, হোমল্যান্ড কলিং।

ইয়োর ভিসা ইজ আপ্প্রুভড, মি: দ্যাত্তা চ্যাউধুরি। আপনি এখন আসতে পারেন।

--

Saturday, October 11, 2014

মাম্মা ওয়াঞ্চস য়ু টু সিট ডাউন, নাউ (প্রথম পর্ব)

ইমিগ্রেশনের কাগজটা দিয়ে গেল। বাপ-ঠাকুর্দার ঠিকুজী কুষ্ঠী, কত টাকার জিনিস নিয়ে দেশে ঢুকছেন তার লম্বা ফর্দ।

ভদ্রলোকের টাকমাথা, নুয়ে পড়া চেহারা। দশটা-পাঁচটার সরকারী চাকরি করা বয়স্ক একজন মানুষ যেমন দেখতে হয়। একটু এদিক ওদিক দেখে, মাথাটাকে আরো কয়েক ইঞ্চি নুইয়ে দিয়ে, আমার কানের কাছে এনে, প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ে ... উইল ইট বি ওকে … যদি আমি … মানে … ইফ আই ... ড্রিঙ্ক ... দুত্তেরি ... মানে ... টেক সাম হুইস্কি।

আমি ঠিক সেই মুহূর্তে খুব বোদ্ধার মত স্কচ-অন-দ্য-রক্‌স ব্যাপারটা নামানোর চেষ্টা করছি। তবে কিনা ইকনমির টিকিট থুড়ি রেড লেব্‌ল, তাই অ্যাপেল জুস না মিশিয়ে ব্যাপারটা গলা দিয়ে ঢালা যাচ্ছে না।

এদিকের ঘটনা ঠিক পরিষ্কার নয়। আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে নুয়ে পড়া কাকু, নীল জ্যাকেটের সাইড পকেট থেকে, প্লেন কোম্পানির ছাপ মারা, রেড লেবেলের ছোট্ট প্লাস্টিকের বোতলটা একটুখানি বার করে দেখালেন।




ওঁকে কিছুটা থামিয়ে দিয়েই বলে ফেললাম, কাকু দু লিটার লিমিট, এয়ারহোস্টেস আপনাকে যেটা দিয়েছেন সেটা মোটে পঞ্চাশ এম এল। কাস্টম্‌স আপনার দিকে তাকিয়েও দেখবে না। ওরা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না। আর আপনি তো রীতিমত উইদিন ইয়োর লিমিট্‌স। বুক ফুলিয়ে গট গট করে বেরিয়ে যাবেন।

আর হ্যাঁ, আমি বাংলা বলতে পারি। একটু আগে এয়ারহোস্টেসের সাথে ইংরেজীতে কথা বললাম, কারণ এয়ারহোস্টেস বাংলায় কথা বলতে পারেন না।
এবার একবারও ধাক্কা না খেয়ে সাবলীল নুয়ে পড়া কাকু, তুমি নিয়েচো? মানে হার্ড ড্রিঙ্ক্‌স নিয়েচো?

আচ্ছা যন্ত্রণা!
আমি কি সত্যিই দিন কে দিন সুবোধ বালক টাইপ দেখতে হয়ে যাচ্ছি? এরকম প্রশ্ন হঠাৎ?

বরফ আর স্কচের সূক্ষ্ম ব্যালান্সটা মুলতুবি রেখে ভালো করে তাকাতেই হল।
প্লেনের সিটে বসে থেকে অব্দি, ভদ্রলোকের নুয়ে পড়া চেহারাটা ছাড়া আর একটাও বিশেষত্ব চোখে পড়ে নি। গভীর রাতের ফ্লাইট, তাই দরজা বন্ধ করেই তড়িঘড়ি করে সব্বাইকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখনই প্রথম ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর শুনলাম।

উজ্‌ য়ু লাইক টু হ্যাভ অ্যা ড্রিঙ্ক স্যার?
স্বর্ণকেশী ছয় ফুটিয়ার দিকে তাকিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে নুয়ে পড়া কাকু, ইয়েস। ওনলি হার্ড ড্রিঙ্ক্‌স।

নুয়ে পড়া কাকু খুব মন দিয়ে এমিরেটসের ইকনমি ক্লাসের ভিডিওতে প্লেনের যাত্রাপথ দেখছেন। ওনাকে নুয়ে পড়া কাকু বলতে আর ইচ্ছে করছে না। নুয়ে পড়া কথাটার মধ্যে কিরকম একটা অসম্মান মিশে আছে।
অথচ প্লেনে উঠে অব্দি ভদ্রলোক ঘাড় নুয়ে বসেই আছেন।
আমি ভালো নাম দিতে পারি না। বিনয় করছি না, প্রুভেন সমস্যা। দু-একজন হলেও-হতে-পারে প্রেমিকার এরকম অভিযোগ ছিল।

আপাতত সুবিধের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক ওনার নাম নুপ কাকু।

নুপ কাকু প্লেনে উঠে থেকেই কড়া নজরে রেখেছেন পুরো সিস্টেমটাকে। মানে প্লেন বেচাল হচ্ছে কিনা, ট্র্যাফিক জ্যামে স্লো হয়ে যাচ্ছে কিনা। মাঝে মাঝে প্লেনের স্পিড আর টাইম টু ডেস্টিনেশন দিয়ে গুণ করে কলকাতা কদ্দুর সেই হিসেব করা। যদিও দূরত্বের হিসেবটাও রয়েছে স্ক্রিনে। একবার তো কয়েক'শো কিলোমিটার কম বেরোলো। একটু অস্থির হয়ে পড়লেন। কয়েক মুহূর্ত পরে গুই (গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস) রিফ্রেশ হতেই সব হিসেব মিলে গেল, আর মাছের-ওজন-কম-ধরতে-পারা আনন্দে নুপ কাকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বিড়বিড় করে বললেন, পথে এসো বাবা।
পাইলটকে উদ্দেশ্য করেই বললেন হয়তো।

আমি একটা মেন্টাল নোট নিলাম। অত্যাধুনিক প্লেনে এ ধরনের রিভার্স কম্যুনিকেশনের বিলক্ষণ প্রয়োজন রয়েছে। বেচারা পাইলটের তো জানা দরকার, লোকে শুধু গবগব করে চিকেন স্যালাড খেতে খেতে সিনেমা দেখে না, রিয়েল টাইম কড়া রিভিউ হয় রীতিমত।

ব্যাক টু প্রেজেন্ট টেন্স। এখন অবশ্য নুপ কাকুর চোখের ভাষা পড়ে নিতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না।
আমার তো মোটে একটা টি শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার। তাতে তো জ্যাকেটের জিপার দেওয়া পকেটের নিশ্চিন্ত আশ্রয় নেই। ‘হার্ড’ ড্রিঙ্ক্‌স আমি নিলাম কোথায়? র‍্যাদার, লুকোলাম কোথায়?

কাকুকে নিশ্চিন্ত করতে ব্যাখ্যা করতেই হল, মোটে চার লিটার সোমরস নিয়েছি, নিচে নেমে সহযাত্রী কোলিগের ঘাড় দিয়ে চালাবো বাকি দু লিটার। আমার মদ্যপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে মদ কোম্পানি একটা ট্রলি ব্যাগে যত্ন করে সব বোতল ভরে দিয়েছেন।
কাকুর মুখে প্রশংসাসূচক হাসি ভেসে উঠতেই টের পেলাম, পাস মার্ক্স পেয়ে গেছি। হয়তো বা ডিস্টিঙ্কশন’ও।

আসলে, জানো তো বন্ধুদের দেখাবো বলে, নিয়ে নিলাম।
সে বেশ করেছেন, কিন্তু প্লেনের মধ্যে একটা ড্রিঙ্ক নিলেন না কেন? আমি তো ভাবছিলাম একসাথে চিয়ার্স করবো।

না, আসলে আমি ভাবছিলাম সবাইকে একটা করেই বোতল দেবে ... কিন্তু তারপর দেখলাম ... এই তো তুমিই দুটো নিয়েছো। ওই সামনের সিটে ডানদিকে একজন চারটে নিয়েছে। আমি আসলে ...

ঠিক আছে, এখন একটা নিয়ে নিন।
চলে গেল যে? আবার ডাকবো? সিট বেল্টে হাত দিয়ে কেবিনের পেছন দিকে তাকালেন নুপ কাকু।

কোনো ব্যাপার’ই না, এই সুইচটা টিপলেই ওরা এসে খোঁজ করবে। সামনের ডিসপ্লের অসম্ভব জটিল ড্যাশ বোর্ডের মধ্যে থেকে সুইচটা খুঁজে বার করে, আপনার-সহযাত্রী-সব-জানে মুখ করে কাকুর দিকে তাকালাম।
না থাক।

এখন আর খাবো না।

প্লেন ইন্ডিয়া ঢুকে পড়েছে, সাহেবী ভদ্রতার আর প্রয়োজন নেই, মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, সে কি? কেন?
না মানে ইয়ে ... তোমার ... মাসীমা। একসাথে সিট পাই নি। ওই পিছনের সিটে, এখনও জেগে আছে। বেশী রাত করে হার্ড ড্রিংক করলে ... আবার ...

বুঝেছি। ছেলে-মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছিলেন?

না, আমরা সবাই আলিপুর থেকে বেড়াতে এসেছি। মোট পঁয়ত্রিশ জন। কক্স অ্যান্ড কিংস। ইওরোপ ট্রিপ। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল। তো বেরিয়ে পড়লাম দু’জন মিলে।

কোথায় কোথায় গেলেন?
প্লেনে করে লন্ডন গেলাম। সেখানে দুদিন ছিলাম। তারপর সেখান থেকে বাসে করে প্যারিস, ওখানেও দুদিন। সেখান থেকে জেনেভা, তারপর ইটালি, মানে রোম। বেশ ভালো ঘুরিয়েছে। গাইড দিয়েছিল সঙ্গে। ভালো গাইড, হিন্দীতে কথা বলছিল।

কেমন ঘুরলেন?
বেশ ভালো। ঘুরলাম, খাওয়া দাওয়া বেশ ভালো ছিল। ব্রেকফাস্ট, কন্টিনেন্টাল ডিনার। মানে বেশ বাঙালি খাবার, চিকেন, ভাত। লাঞ্চটা অবশ্য নিজের। ওটায় একটু খরচা হয়ে গেল। তা হোক, অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল জানো, ইওরোপে ঘুরতে যাবো। ওরা আমাদের দেশে আসে, স্প্ল্যানেডে তো প্রায়ই দেখি ঘুরে বেড়ায়। আমরা যেতে পারি না? তো এবার জানুয়ারিতে একটা এফ ডি ম্যাচিওর করলো, আমি গিন্নীকে বল্লুম, চলো – বয়েস হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে, আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না। তোমার মাসীমা অবশ্য গাঁইগুঁই করছিল, শাড়ি পড়তে দেবে কিনা।

আরে সে রকম গাদা গাদা ছবি তো ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাবেন।
না আমি ইন্টারনেট’টা ঠিক ... আমাদের সময় আসলে ওসব ... তবে ট্রাভেল এজেন্টের ব্রোশিয়োরে একটা ছবি ছিল। সেটা দেখিয়েই রাজী করালাম। চল্লিশ বছর ধরে চিনি তো ওকে। নইলে আসত’ই না। আর ওকে ছাড়া কখনও ...... মানে বাইরে ...


বুঝেছি।

--

কলকাতায় নেমে ই-বোলার ফর্ম ভরে, ইমিগ্রেশনের খেঁকুটে ভদ্রলোকের সামনে যাওয়ার আগে কি মনে হল, ঘুরে তাকালাম।
ওই তো কাকু দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনের পরে। সাথে মাসীমা।

আসি কাকু, পরের বার কিন্তু একসাথে চিয়ার্স করব।
ভালো থেকো বাবা। আবার দেখা হবে।

কলকাতায় নেমে গেছি। বাংলা কথা শুনতে আর কান খাড়া করে বসে থাকতে হবে না। কিন্তু তাও আরো একবার ঘুরে তাকাতেই হল। ওই তো নুপ কাকু তাকিয়ে আছেন, উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ, ততোধিক উজ্জ্বল একমুখ হাসি। নুয়ে পড়া দেহ থেকে একরাশ ভালোবাসা বেরিয়ে আসছে।

কি দরকার ছিল নুপ কাকুর এই কথাটা বলার। আমি-উনি দুজনেই তো খুব ভালো করে জানি আর কোনোদিনই দেখা হবে না। কি করে হবে?

এতো মানুষ, এতো কথা।

“কিছুই তো আর যায় না শোনা, কার কথা কে বুঝবে বল/
বুঝতে হলে কথার মানে, চেনা পথের বাইরে চল।
তবুও কিছু যায় না বলা, শব্দ খেলায় কেবল ফাঁকি/
কথার পিঠে কথা সাজাই, আমরা এখন একলা থাকি।।”

(চলিবে, লেখার শিরোনাম খুব সম্ভবত মিসলিডিং - আমার বস্টন ট্রিপের ট্রাভেলগ)

Sunday, September 21, 2014

এ পুলিশ কেমন পুলিশ #HokKolorob

এ পুলিশ কেমন পুলিশ, উর্দি ছেড়ে গেঞ্জি পরো
এ কেমন শাসক তুমি, রাতের বেলায় লাঠি ধরো

বছরের পরের বছর ছাত্র আসে, তুমি একই
ক্ষমতার মাদকের'ই চোরাবালির ধরণ এমন
চুপ নয়, প্রতিবাদেই ছাত্রসমাজ রাস্তা ভরো

এ পুলিশ কেমন পুলিশ, উর্দি ছেড়ে গেঞ্জি পরো
এ কেমন শাসক তুমি রাতের বেলায় লাঠি ধরো

কেঁদেছি আগেও আমি, যখন তুমি বুদ্ধবাদী
সেদিনের লাঠির ঘায়ে ছাত্র-ছাত্রী অশ্রুমতী
অশ্রুর সাথেই প্রেমে জন্ম আমার, আমার মরণ
বরাবর বহিরাগত'র গল্প দেওয়া তোমার ধরণ

লিখেছি স্লোগান আগেও, ভাবছো আমি হদ্দ বুড়ো
ভুলে গেছো আমার ভায়ের বয়স আজকে ঠিক আঠেরো

এ পুলিশ কেমন পুলিশ, উর্দি ছেড়ে গেঞ্জি পরো
এ কেমন শাসক তুমি রাতের বেলায় লাঠি ধরো।

- কবীরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী
অনির্বাণ দত্ত চৌধুরী

#HokKolorob

Saturday, August 16, 2014

সূর্যগ্রহণ ও ছেঁড়া পরোটা

কিছু কিছু মানুষ বিজ্ঞানের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হন। স্কুলের স্যারেরা পড়তে বলেছেন বলেই সায়েন্স পড়েছেন অথবা মাধ্যমিকে বেশী নম্বর পেয়েছেন বলেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছেন এরকম নন। মাধ্যমিক ব্যাপার’টা অবশ্য উঠে যাচ্ছে (বা গেছে)।

এরকম একজন মানুষ হলেন আমার বাবা। আমার বাবা বৈজ্ঞানিক নন, কিন্তু নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কিনে ফেলা এবং অত্যন্ত উৎসাহের সাথে ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার বাবার স্বভাব। বহুদিনের স্বভাব।

ক্লাস সিক্সের আমি একজোড়া ওয়াকিটকির একটা নিয়ে ডক্টর’স কোয়ার্টারের সামনের মাঠ পেরিয়ে একদম শেষে চলে গেছি। তিনতলার কোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবা অন্য ওয়াকিটকিটায় জোরে জোরে বলে যাচ্ছে, “শোনা যাচ্ছে? কি রে, শুনতে পাচ্ছিস? দোকানে বলেছে মিলিটারি গ্রেড। এক কিলোমিটার অব্দি কাজ করবে।”

শোনা যাচ্ছে, এবং আমি প্রাণপণ চেল্লিয়ে (যদিও দরকার ছিল না, ওয়াকিটকি কাজ করছিল) সেটা জানান দেওয়া মাত্র নির্দেশ এলো – আরো দূরে যা। মুশকিল হচ্ছে আড়াআড়িভাবে মাঠ পেরোনোর পরে কচুরিপানার জঙ্গল।

মফস্বল থেকে এটাও উঠে যাচ্ছে। মশার যেমন গুড নাইট, কচুরিপানার প্রোমোটার।

যাগ্‌গে, কার্গিলে কম্যান্ডারকে পরিস্থিতি জানানোর মত তৎপরতায় (স্যালুট ছাড়া) বাবাকে জানালাম যে আর এগোনো সম্ভব নয়। সামনে ওয়াটার ফ্রন্ট।

"হুম্‌, তাহলে আর কি। ফেরত চলে আয়। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ হল কি বলিস ... বেতার ফোন। তুই এবার পাড়ার মধ্যে কোথাও গেলে এটা নিয়ে যাবি। মুদীর দোকানে গিয়ে কত গ্রাম বেগুন মনে না পড়লেই মাকে ওয়াকিটকিতে - ওভার অ্যান্ড আউট।"
বলা বাহুল্য – ঘটনা আর এগোয় নি। ওয়াকিটকির সেই শুরু আর সেই শেষ – পঁচানব্বই সালে কেনা সাত হাজার টাকার ওয়াকিটকির প্রথম ও শেষ ব্যবহার।

ওই সময় নাগাদ আরেকটা ব্যাপার ঘটেছিল, যেটা এক্ষুণি লিখে ফেলা দরকার। সূর্য গ্রহণ। পূর্ণ গ্রহণ।

ডায়মন্ড রিং বলে একটা ব্যাপার দেখা যাবে যেটা জৌলুসে পি সি চন্দ্র কে বলে বলে দশ গোল দেবে।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল সেই অঙ্গুরীয় আমাদের খড়দার কোয়ার্টারের ছাদ থেকে দেখা যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে বারুইপুর হচ্ছে এই শো’র ব্যালকনির সিট। খড়দা থেকে গ্রহণ দেখা নিশ্চয়ই যাবে, কিন্তু ওই ড্রেস সার্কেল মার্কা দেখা হবে।

সুতরাং শুভ দিনে আমরা মেন লাইনের ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ এবং সাউথের ট্রেন পাকড়ে বারুইপুর চেপে এলাম। ট্রেনে আসা শুধু মাত্র সুবিধেজনক ছিল না, বাধ্যতামূলক ছিল। কারণ আমার চারচাকা সংক্রান্ত মোশন সিকনেস।

ক্লাস নাইন অব্দি আমার একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল – বাসে উঠে ঠিক সাত মিনিটের মাথার হড়হড় করে বমি করা। উইদাউট ফেলিওর। ওপেন করে সচিনের সেঞ্চুরির মত। বা ক্লাবের হয়ে মেসির গোল করার মত। তার থেকেও নির্ভুল, নিশানায় অভ্রান্ত।

পেটে খাবার নেই, মানে বাড়ি থেকে না খাইয়ে আনা হয়েছে ব্যাপারটা আটকানোর জন্য। কোই পরোয়া নেই, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে বেরোনো হর্মোনগুলো, আমার পাকস্থলী সার্চ করে কিছু না পেয়ে পিত্ত তুলে আনত। সেই প্রথম জানা পিত্তি জ্বলে যাওয়া কাকে বলে। আক্ষরিক অর্থে।

শুরুর দিকে বাবা-মা কি করে সামলাতেন সেটা আমার মনে নেই। ক্লাস ওয়ান-টু থেকে যেটা শুরু হয়েছিল – বাসে উঠেই মা জানালার ধারে বসা কাকু-কাকিমাকে বলতেন, “ওকে জায়গাটা ছেড়ে দেবেন প্লিজ, মোশন সিকনেস আছে। একটু পরেই বমি করবে।” কেউ কেউ বিশ্বাস করে, দয়া-পরবশ হয়ে ছেড়ে দিতেন। আর যাঁরা দিতেন না, মা তাঁদেরকে সতর্ক করতেন, “দেখুন ও কিন্তু সত্যিই করবে, জানলার পাশে বসলে বাসের বাইরে, নইলে ......”
এই পৃথিবীতে কোনো কোনো মানুষ অসম্পূর্ণ কথার মানে বুঝতে পারেন না। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখেছি তাঁরা পস্তান। এক্ষেত্রেও অন্যথা হত না। তাঁরা গোঁ ধরে জানলার ধারে বসে থাকতেন। এবং ঠিক ছয় মিনিট বাদে (কথাবার্তায় এক মিনিট কেটে গেছে) ব্যাপারটা ঘটত।

বহু অভিশাপ সংগ্রহ করেছি আমি এই পদ্ধতিতে। পার্টিতে মদে অচেতন বন্ধু/বান্ধবীকে উদ্ধার করার সময় একটা একটা করে অভিশাপ কাটাই। কিন্তু জন্ম থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত সব অভিশাপ কাটাতে গেলে আমাকে যে পরিমাণ পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হবে, সেটা ঠিক ...

বেশ খানিকটা বাজে বকে দিলাম। ব্যাক টু বারুইপুর। বিজ্ঞান সংসদের চশমা জোগাড় করে হয়েছে সূর্য গ্রহণ দেখার জন্য। কিন্তু চশমা’টা কি সত্যিই পর্যাপ্ত পরিমাণে কালো? মানসিক শান্তির জন্য শেষ মুহূর্তে হাসপাতালের নষ্ট হওয়া নিকশ কালো এক্স রে প্লেটেই ভরসা রাখা হল।

তারপর দেখা গেল – ডায়মন্ড রিং। কালো এক্স রে প্লেটের মধ্যে দিয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়া আকাশকে আরো কালো করে দিয়ে, হঠাৎ চারপাশে ঝটফটিয়ে পাখি উড়ে যাবার শব্দ। কিন্তু ওই বিশেষ দিনটির কথা আমার হীরের আংটির জন্য মনে নেই।

মনে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া পরোটার জন্য।

আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, ছোটোবেলা থেকে চারপাশ দেখেই সেই ধারণা গড়ে উঠেছিল – পরোটা সংখ্যা গুণে বিক্রী হয় – এবং অর্ধেক বা ছেঁড়া বিক্রী হয় না। এটা যেন একটা থিওরেম। পরোটা থিওরেম।

আংটি দেখে যখন আমি আর বাবা বারুইপুর স্টেশনে তন্নতন্ন করে খাবার-দাবার খুঁজছি – তখন দেখা গেল রাশি রাশি পরোটা ছিঁড়ে ওজন করে বিক্রি হচ্ছে। রীতিমত দাঁড়িপাল্লার একদিকে ওজন আর অন্যদিকে পরোটা। পরোটার দিকে ওজনে বেশী হয়ে গেছে। দোকানি একটু ছিঁড়ে কমিয়ে দিলেন।
আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমি আর বাবা মিলে তিনশো (গ্রাম) পরোটা খেয়েছিলাম। আমার পরোটা থিওরেম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছিল।

ঠিক পরের স্কুলের বাংলা পরীক্ষায়, রচনায় তিনটে অপশন ছিল - রবীন্দ্রনাথ, বর্ষাকাল আর সূর্য গ্রহণ। সেফ রবীন্দ্রনাথ এবং ততোধিক সেফ বর্ষাকাল ছেড়ে সূর্য গ্রহণের মুখোমুখি হয়েছিলাম – ভালো নম্বরের আশায়। আনকমন টপিক লিখলে স্যারেরা বুঝতেন যে খাতায় উগরে দেয় নি, নিজে লিখেছে। নম্বরটাও ঢেলে দিতেন।

কিন্তু তিন পাতার রচনার মধ্যে এক পাতা পুরোটাই ছেঁড়া পরোটার বর্ণনা থাকায় স্যার রচনায় ভালো নম্বর দিতে পারেন নি। ডেকে বলেছিলেন, “দ্যাখ্‌ পরোটার সাথে সূর্য গ্রহণের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তুই লিখেছিস্‌ ভালোই, কিন্তু তাও নম্বর দিতে পারলাম না!”

আজো পৃথিবীর যে কোনো কোথাও, অথবা ইন্টারনেটে সূর্য গ্রহণের ছবি দেখলেই আমার মনে পড়ে – শরতের পেঁজা তুলোর মতন নরম ছেঁড়া ছেঁড়া পরোটা।

Thursday, August 7, 2014

মগ্নমৈনাক

(১)

মৈনাক আজ অনেক দিন পরে স্কুলের পাড়ায় এসেছেন। প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেল।
তখন মৈনাকরা ভাড়া থাকতেন। একটা দোতলা হলুদ রঙচটা বাড়ির একতলায়। এই তো সেদিনকার কথা। টেস্ট দিয়ে হই হই করতে করতে বাড়ি গেলেন। টেস্টের পরে টানা তিনমাস ছুটি। বাড়ি বসে পড়তে হবে। তারপর মাধ্যমিক।

তি--ন--মা--স।

ভাবা যায়? গরমের সময় একমাস ছুটি ছাড়া স্কুল জীবনে এতোটা টানা ছুটি তো বলতে গেলে পাওয়াই যেত না।
টানা এক মাস ছুটি - সেটাকে কম মনে হত।

সত্যি? …… এরকম জীবন ছিল না কি কখনো?

অবিশ্বাসে ভরা চোখে স্কুল বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে থাকেন মৈনাক। ভ্রু কুঁচকে গেছে। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো? ক্লাসরুমের সবুজ দরজা গুলোকে কি বিশাল মনে হত তখন। পাল্লাগুলো যেন ঘিরে ধরছে, দরজার ফ্রেমের ওপরের দিকটা তো ক্লাস সেভেন অব্দি লাফিয়ে ধরতে হত। তারপর গোড়ালিতে ভর দিয়ে। আচ্ছা, এখন ছুঁতে গেলে কেমন হত?

আজ তো ছুঁয়ে দেখা হবে না - শনিবার স্কুল বন্ধ, পরে একদিন উইকডে তে আসতে হবে। আসতেই হবে।

বাকেট লিস্ট।

টেস্ট দিয়ে অবশ্য মৈনাক সরাসরি বাড়ি যান নি। স্কুলের পরে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট-গল্প-আড্ডা সেরে স্কুল থেকে বেরিয়েছিলেন। হারকিউলিস সাইকেল, ঘন সবুজ রঙের। চেন কভার দেওয়া আছে। সিটের হাইট বাইশ ইঞ্চি থেকে বাড়িয়ে চব্বিশ ইঞ্চি করা হয়েছে। বাবার টোটকা। এতে নাকি ছেলে আরও চটপট লম্বা হবে।

মিথ। একদম ফালতু মিথ।
হাজার সাইকেলে চড়েও মৈনাক পাঁচ সাতের বেশি উঠতে পারেন নি।

বন্ধুদের শেষবারের মত টাটা করে মৈনাক হারকিউলিসের প্যাডেলে চাপ দিয়েছিলেন। দেরী হয়ে যাচ্ছিল। সাইকেলে চেপে, হ্যাঁ ওই বাঁদিকের রাস্তা দিয়েই প্রতিদিনের মত, এগোচ্ছিলেন। প্যাডেলে একটু জোরে চাপ।

স্কুলের পরে লাইব্রেরী, তারও দুটো গলি পরে বাবুনদের বাড়ি ছাড়িয়ে কথোপকথনের সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে থাকবে। মালতীবালা স্মৃতি বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের ছাত্রী ছন্দা।

আর কথোপকথন একটা এস টি ডি বুথ।

মারাত্মক পপুলার এস টি ডি বুথ। কাজের ফোন, অদরকারে ফোন, স্কুলের ফোন, কাজের মাসীর ফোন, আর সর্বোপরি প্রেমালাপের ফোন। সদা ব্যস্ত।
টেস্টের পরে দুজনের স্কুলেই ছুটি পড়ে যাচ্ছে, এর পর নিয়মিত দেখা করা যাবে না। তাই সেদিন স্পেশাল অ্যাপো। একটু বেশী সময় কাটানো।

প্ল্যান তাই ছিল। ইন ফ্যাক্ট, মৈনাক বেশ সুন্দর দেখতে কাঁথা স্টিচের মলাটের ডায়েরীর ভেতরে গোলাপ লুকিয়ে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

কিন্তু গড ডিজপোজ করলেন।

বৃষ্টি নেমে এলো। অঝোর ধারে। মৈনাক হাঁ করে বৃষ্টিতে ভিজছেন। কাঁথা স্টিচের ডায়েরীও ভিজছে।

অসময়ের বৃষ্টি।

কথোপকথন বন্ধ, সবুজ রঙের পিসিও, হলুদ রঙের এসটিডি আর লাল রঙের আইএসডি। এসটিডি লেখাটা বাঁদিকে কিছুটা উঠে গেছে। মৈনাকের জামা ভিজে সপ্‌সপ্‌। দুপুর বেলায় কে আর ফোন করতে আসে? সেই সন্ধ্যে হলে, যদি ঝড় থামে, তবেই কথোপকথন খুলবে।

দশ বারোটা বাড়ি পরে সুমনের বাড়ি - গেলেই হত। কিন্তু মৈনাক যান নি। কাকীমা যদি জিজ্ঞেস করে বসেন - এখানে কোথায় এসেছো মৈনাক?

মৈনাকদের বাড়ি তো রেললাইন পেরিয়ে সেই রবীন্দ্রপল্লীতে। পুরোটা উল্টোদিকে। কাকিমাকে কি জবাব দিতেন মৈনাক?

স্কুল গেটের সামনে দাঁড় করানো হণ্ডা সিটির ভেতরে আজকের মৈনাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শেষ কবে নিজের স্কুল বা কলেজের সামনে বৃষ্টিতে ভিজেছেন সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেও সে আশা পূর্ণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। দুর ছাই, বাকেট লিস্টে আর একটা আইটেম যোগ হল।

বায়োলজির স্যার জীবনবাবু পড়াতেন, যে প্রাণী জীবনধারণের জন্য অন্য জীবের ওপর ভরসা করে তাকে পরজীবী বলে। পরজীবি দুপ্রকার হয়, মিথোজীবী – আর ... আর একটা মনে পড়ছে না। স্কুলের জীবনটা বোধহয় মিথোজীবিতা ছিল, তাঁদেরও স্কুলকে প্রয়োজন, স্কুলেরও প্রয়োজন ছাত্রের।

সেদিন মৈনাক মিনিট দশেক সাইকেলে বসে থেকে, ভ্যাবলার মত ভিজে বাড়ি চলে এসেছিলেন। জানতে পারেন নি আরো কিছুক্ষণের মধ্যে, ছন্দা, বৃষ্টিতে রিকশা না পেয়ে জল ঠেলে ঠেলে কথোপকথনের সামনে হাজির হয়েছিল। চারদিন বাদে যখন জানতে পারলেন, তখন বড্ডো দেরি হয়ে গেছে। ছন্দা জ্বর-টর বাঁধিয়ে বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার। মৈনাক ভয়ে ছন্দাদের বাড়িমুখো হন নি।

একজন বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়ায় নি।

তারপর কালের নিয়মে মাধ্যমিক এল। চলেও গেল। অ্যাডিশনাল পরীক্ষার শেষে মালতীবালার সামনে থেকে ছন্দাকে পাকড়াও করলেন মৈনাক। ছন্দা এড়িয়ে যাচ্ছিল, মৈনাক’ই জোর করেছিলেন।

আবার সেই কথোপকথন। আবার সেই ফিসফিস।

- তুমি দেরী করে এসেছো, তাই আমায় দেখতে পাও নি। প্লিজ এটা নিয়ে আর রাগ কোরো না। লক্ষীটি, প্লিজ।
- ওই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসছি, দেরি তো হবেই ...... এসেছিলাম এই ঢের। তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে না কেন?
- ছিলাম তো, পাক্কা দশ মিনিট। আর কতক্ষণ থাকবো?
- তোমার তো সাইকেল, টুক করে এসেছো, আবার টুক করে চলে গেছো। আমি কি জানতে গেছি নাকি কখন এসেছো? আদৌ এসেছো কিনা?
- কি? ... আমি আসি নি? তুমি এটা বলতে পারলে? আমি মিথ্যে কথা বলছি?
- বলতেই পারো, তোমায় তো আর কম দিন দেখছি না।

ফিসফিস কখন হিসহিসে পরিণত হয়েছে, মৈনাক-ছন্দা টেরও পান নি। টের পাওয়ার কথাও নয়। হিসেব মেলানোর সময় কে আর অত ভাবে।

- ছন্দা আমি এসেছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোমার জন্য একটা কাঁথা স্টিচের ডায়েরি ......
- কি জানি বাবা, কিছুই বিশ্বাস নেই। তোমরা ছেলেরা কথায় কথায় ঢপ দিতে পারো।
- তাই যদি হয়, তাহলে দেখা না করলেই হয়। এতোই যদি অবিশ্বাস, তাহলে ......
- কে চেয়েছে দেখা করতে? আমি? না তুমি? টেনে টেনে আমাকে এখানে নিয়ে এলো কে? মৈনাক, আমার আর তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না ......
- প্লিজ ছন্দা, একটু ভাবো, মাধ্যমিক ছিল সামনে।
- আরে ... ভারী আমার মাধ্যমিক রে। নম্বর কি পাবে সেতো জানা আছে। আবার বড়ো বড়ো কথা।

খোকন’দা কথোপকথন থেকে মুখ বাড়ালো।
তোদের হয়ে গেলে জানাস। রঙের মিস্ত্রীকে খবর দিতে হবে।
কেন খোকনদা?

দোকানের নাম মুছে আবার লিখতে হবে, কথোপকথন চলবে না। ভাবছি নতুন নাম দেব।

কলহ।

তখনকার মত হেসে ফেললেও, মৈনাক টের পেয়েছিলেন একটা ধাক্কা। একটা জোর ধাক্কা। মনের মধ্যে একটা জেদ। সত্যিই তো লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র তিনি। পড়াশোনায় বরাবরই মোটামুটি। ছন্দা কিছু ভুল বলে নি। কিন্তু এত জনের সামনে বলল। কথাটা কি তাচ্ছিল্যের সাথেই না বলল। বিদ্রূপের হাসি মাখানো ছিল। খোকনদাও হাসছিল।
ছন্দাকে দেখিয়ে দিতে হবে। রেজাল্ট কাকে বলে সেটা ছন্দাকে দেখিয়ে দিতে হবে।

তা দেখিয়েছেন বটে মৈনাক।

হায়ার সেকেন্ডারি থেকে শুরু করে জীবনের পরের পরীক্ষাগুলোয় ক্রমাগত সাফল্যের ধাপ উৎরেছেন। ছন্দা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, নতুন সম্পর্ক। ভাঙ্গা-গড়া। মাল্টি-ন্যাশনাল অফিসে ঢুকে তরতর করে উন্নতি। অফিসের সহকর্মীর সাথে প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে।

ছন্দার সাথে আর কোনোদিন কথা বলা হয়ে ওঠে নি মৈনাকের। সত্যিটা হল মৈনাক কথা বলেন নি ইচ্ছে করে। ছন্দা অবশ্য ক্লাস ইলেভেনে, বারদুয়েক কমন বন্ধু মারফত যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন।

আহত মৈনাক কোনো উৎসাহ দেখান নি। শুধু একটা ভেজা কাঁথা স্টিচের ডায়েরি বন্ধু মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যস্‌।

ছন্দা কোনোদিন সেভাবে আর মৈনাকের জীবনে ফিরে আসেন নি। হায়ার সেকেন্ডারিতে জেলায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে কলকাতায় চলে এলেন।
ক্লাস নাইন-টেনের ‘দুরন্ত’ প্রেম মৈনাকের জীবনে ব্যারাকপুর লোকাল হয়েই রয়ে গিয়েছে।

কলেজ-ইউনিভার্সিটির বাকি সম্পর্কগুলো মৈনাকের সেভাবে মনেও পড়ে না। কিন্তু মালতীবালা স্মৃতি বিদ্যালয়ের ছন্দা, ক্লাস টেনের বিনুনি বাঁধা ছন্দা, মানুষ মৈনাক’কে চিরকালের জন্য পালটে দিয়ে গেছে।

ইঁদুরদৌড়ের লাস্ট ল্যাপে, পাকা ম্যারাথন রানারের মত স্পিড বাড়িয়ে, প্রথম ঝাঁকটায় ঢুকে পড়েছেন মৈনাক। কুড়ি বছর আগের, ছন্দার সেই অপমানের বদলা নেওয়ার দৌড় এখনও চলছে। দৌড় থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখছেন না মৈনাক।

মৈনাক খুব মন দিয়ে ভেবে দেখলেন, সেই তুলনায় ছন্দার জীবনে তাঁর সেরকম কোনো ভূমিকাই নেই। থাকতে পারে না।

শুধু এক সেই বাল্যপ্রেম।

আর বাল্যপ্রেমে ...... সে তো সবাই জানে ......

(২)

হাঁটতে হাঁটতে কখন কথোপকথনের সামনে পৌঁছে গিয়েছেন খেয়ালই ছিল না মৈনাকের। কিন্তু দোতলা বাড়িটার নীচতলায় কথোপকথন কই? এ তো মোবাইলের দোকান।

মৈনাক একটু উঁকি-ঝুঁকি মারলেন। ওই তো কে একটা বসে আছে। খোকনদা কি? হ্যাঁ, সেরকমই মনে হচ্ছে। খোকনদাই বসে আছে। মাথা ফাঁকা প্রায়। চেহারায় একটা হাল্কা সফল ব্যাবসায়ী জেল্লা চলে এসেছে, আর চোখে চশমা। দোকান ভালোই চলে মনে হয়, এসি চলছে। খুব দামী মোবাইল সেট নেই। কিন্তু দোকানে কাটতি আছে, সেটা লেটেস্ট মোবাইলের পসরা দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে।

দোকানের নামটা অবশ্য খোকনদা পালটায় নি। নিয়নের লাইট জ্বলছে - কথোপকথন।

বাকেট লিস্টে আরেকটা আইটেম যোগ হতে দেওয়া যায় না। মৈনাক ঢুকে পড়লেন। হেডফোনটা অনেক দিন ধরেই বেগড়বাঁই করছে, এমনিতেই কিনতে হত।

খোকনদা চিনতে পারল না। সেটাই স্বাভাবিক। মাধ্যমিকের পরে আর দু-বছর ছিলেন মৈনাক এই স্কুলে। কুড়িটা বছর চলে গেছে। আঠেরো আর আটত্রিশে যে বড্ডো বেশী তফাত।

একটা চলনসই হেডসেট কিনে মৈনাক নিজের পরিচয় দিলেন। খোকনদা প্রথমে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর হো হো করে হেসে ফেলল।

- সে কি রে, আপনি ... মানে ... তুই? কতদিন বাদে দেখলাম রে? তা প্রায় বছর কুড়ি হবে ... হবে না?
- হ্যাঁ, এক্স্যাক্টলি কুড়ি’ই। তোমার দোকানে তখন একটা এস টি ডি বুথ ছিল, সবাই খুব ফোন করতে আসত।
- ঠিক ঠিক, তারপরে একটা ইন্টারনেট কাফে করেছিলাম, জানিস। তদ্দিনে তোরা পাস করে চলে গেছিস। কিন্তু তাও শেষ দিকে আর চলছিল না, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ঢুকে পড়ল। এই বছর পাঁচেক হল, ওটা পালটে মোবাইলের দোকান দিলাম। তবে কি জানিস, দোকানের নামটা কিন্তু পাল্টাই নি একবার’ও। তো অ্যাদ্দিন বাদে হঠাৎ ...... স্কুল দেখতে এসেছিস তুই?
- হ্যাঁ, ওই ... আর কি।
- তা কেমন দেখলি?
- অনেক কিছুই পালটে গেছে খোকনদা। অবশ্য ... সেটাই স্বাভাবিক। আমিও তো অনেকটাই ...... তুমি কিন্তু অনেকটা এরকম আছো খোকনদা। আচ্ছা, আমাদের ব্যাচের আর কাউকে দেখো নাকি?
- না ... সেরকম কেউ তো এখানে আর থাকে টাকে না। মাঝে মধ্যে তোর মত কেউ আসে। তবে ...
- তবে কি?
- না মানেই, কাছেই একটা নতুন ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুল খুলেছে।
- আরে দূর, আমাদের সময় আবার ইংলিশ স্কুল কোথায়? তুমি আমাদের স্কুলের কথা বলো ......
- আরে শোনই না ...... ওই স্কুলটায় ছন্দার ছেলে পড়ে। ছন্দাকে দেখি, মাঝে মাঝে নিতে আসে। পাশের পাড়াতেই ছন্দার বিয়ে হয়েছে। ছেলেকে এই স্কুলটায় ভর্তি করেছে। আমাকে বিয়েতে বলেছিল। আমার কাছ থেকেই ফোন রিচার্জ করায়।

মৈনাক চুপ।

- কি রে, তোর মনে নেই? তোদের সাথেই তো পড়তো, নাকি আমি ভুল করছি? অ্যাতো বছরে তো আর কম স্টুডেন্ট পাস করল না।
- হ্যাঁ, মানে ... আমাদের সঙ্গেই ...
- দাঁড়া দেখি তুই একটু। ইংরিজী স্কুল। শনিবারও পুরো খোলা। একটু পরেই যাবে এদিক দিয়ে। দ্যাখ, চিনতে পারিস কিনা।

(৩)

খোকনদাই ডাকল – এই যে ছন্দা, ছন্দা – শোনো একবার এদিকে।
একটি ক্লাস থ্রি-ফোরের সাদা-নীল স্কুল-ড্রেস বাচ্চাকে নিয়ে ছন্দা হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটু অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন।

- কি হয়েছে, খোকনদা?
- এই দ্যাখো দেখি, একে চিনতে পারো নাকি?
মৈনাক চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মন দিয়ে ছন্দাকে দেখছিলেন। বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশিরানি। এরকম হচ্ছে কেন? কোথায় যেন শুনেছিলেন – সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লে কোনোদিন সেই ভালোলাগার অনুভূতি উবে যায় না। হাজার চেষ্টা করলেও না।

ফল্গু নদীর মত লুকিয়ে থাকে।

ছন্দা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল – কেমন আছো? এদিকে কোনো কাজে এসেছো?
- না, আসলে হঠাৎ করেই অনেকটা ...
- ভালোই তো, কোথায় আছো এখন?
- টেক্সাস ... মানে অফিসের কাজে।
- বাঃ, কাকু-কাকিমা কেমন? ভালো তো?
- হ্যাঁ বাবা-মা ভালোই আছেন, তোমার?
- হুম্‌ম্‌... বাবা-মা আছে, বেশ আছে। এ বয়েসে যেমন থাকার সেরকম’ই আছে।
- ছন্দা ... তোমার ছেলে?
- হ্যাঁ, লাল্টু ... যা দুরন্ত হয়েছে না।

মৈনাক লক্ষ্য করলেন, ছন্দা তাঁকে একবারও নাম ধরে ডাকলেন না। কাটা কাটা কথা। এতোটা অবহেলা, এতোদিন পরেও। মৈনাকের একটু কষ্ট হল।

লাল্টু একটু রাস্তার ওপারে এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিল। ভারী মিষ্টি ছেলেটি। সাদা জামা নীল হাফপ্যান্ট। ছন্দা কব্জিতে বাঁধা কালো হাতঘড়িটায় একনজর বুলিয়ে, ডেকে উঠলেন - লাল্টু, এদিকে এসো। বাড়ি যেতে হবে, দিদুন ফোন করেছিল। মেঘ করেছে, এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে।

মৈনাক হেসে তড়বড় করে কিছু একটা বলতে গেলেন, কিন্তু কথা খুঁজে পেলেন না। মাথায় একটাই পাক খাচ্ছে – এতোটা উপেক্ষা। প্রাপ্য ছিল তাঁর?
ছন্দা মৃদু বাধ্যবাধকতার হাসি হেসে মৈনাকের দিকে তাকালেন, আজ তাহলে এগোই। ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।

মৈনাক কিছুই ঠিক করে বলে উঠতে পারলেন না। আধখানা ঘাড় নাড়লেন।

ছন্দার সাথে দেখা না হলেই ভালো হত, নিজেকে খুব অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। সেই মাধ্যমিকের পরে, কুড়ি বছর ধরে, মেয়েটি কোনোদিন তার কথা ভাবেও নি। আজ যে দেখা হল, তাতেও তার ওপরে কোনো প্রভাব পরে নি। আজই হয়ত বাড়ি ফিরে স্বামীর সাথে এই ঘটনা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে।

ছন্দার হাত ধরে লাল্টু এগিয়ে যাচ্ছে। মৈনাক দেখছেন। কথোপকথনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। টুপটুপ করে ভারী ফোঁটার বৃষ্টি পড়ছে, একটা ফোঁটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে, গায়ে লাগছে না। পুরো ব্যাপারটা জলছবির মত লাগছে। মৈনাকদের ছোটোবেলায় পাওয়া যেত। খাতার ওপরে রেখে পেন্সিলের পেছন দিকটা দিয়ে ঘষলেই ম্যাজিকের মত ...... এখন কি আর পাওয়া যায়?

মৈনাক পিছু হাঁটছেন। স্কুলের সামনে বৃষ্টিতে ভেজা’টা যে বাকেট লিস্টে ছিল, মৈনাকের সেটা আর এখন মনে পড়ছে না।

(৪)

মোড় ঘোরার মুখে, মৈনাকের পাশ দিয়ে সাদা-নীল একটা তীর ছুটে গেল। লাল্টুর বয়েসী একটি ছেলে। একই স্কুলের হবে।

দৌড়োচ্ছে আর চিৎকার করছে - এই মৈনাক, মৈনাক, লাল স্কেচপেনটা, কালকে মনে করে নিয়ে আসিস কিন্তু।

মার হাত ধরে ছোট্টো মৈনাক ঘুরে তাকালো – ওকে, ওকে … সিওর আনবো।

মোড়ের ওপাশে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে আরেক মৈনাকের হঠাৎ জীবনবাবুর মুখটা মনে পড়লো –

আর এক ধরণের পরজীবী হয় - তাদেরকে বলে - মৃতজীবী।