কে হবে বাংলার হ্যামলিন?
হ্যামলিনের সাথে এই রিয়েলিটি শোর কোনো সম্পর্ক নেই। সিরিয়াসলি নেই। শুধু নামটা ধার নেওয়া। ফান্ডাটা হচ্ছে যে কোনো যন্ত্র নিয়ে প্রতিযোগীরা আসবেন, বাজাবেন। তারপর জাজ’রা প্রাথমিক ফিল্টারিং করবেন। অতঃপর, যে কোনো রিয়েলিটি শো’র অনিবার্য পরিণতি – এস এম এস। তারপর ঠিক হবে, কে বাংলার সেরা বাজানিয়া।
ইন ফ্যাক্ট, পলিটিশিয়ানদের নিয়ে একটা রিয়েলিটি শো, নেক্সট মন্ত্রী কে হবেন, এরম একটা ভাবাই যেতে পারে। প্রথমে একটা কুড়ি মিনিটের সম্মিলিত ঝগড়া, তারপর পাঁচ মিনিটের বক্তৃতা সেশন। তারপর আরো তিন মিনিটের কেচ্ছা সেশন - মানে অন্যরা কে কি কেচ্ছা করছে সেগুলো উজাড় করে দিয়ে নিজের দিকে ভোট টেনে আনা।
পিছনের গাড়ির হর্ণে মধু বাস্তবে ফেরত চলে এল। ট্যাক্সিটা প্রায় পাঁচ মিনিট সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে। নরম্যাল নয় একদমই।
অনেক ভোটাভুটির পরে মধু 'কে হবে বাংলার হ্যামলিন' এর ফাইনাল রাউন্ডে। ফাইনালে পাঁচ জন এসেছে। বেস গীটার, সরোদ, হার্মোনিয়াম, মাউথ অর্গ্যান আর বাঁশি। মধু জানে তিন জনের কোনো চান্স নেই। বেস গীটার, সরোদ, হার্মোনিয়াম বাজছে, ভালোই বাজছে, কিন্তু সেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এক্স-ফ্যাক্টর'টা নেই। চালু হিন্দি গানের সুর বা কয়েকটা গতের রাগ বাজিয়ে টেনেটুনে ফাইনালে আসা যেতে পারে, কিন্তু ফাইনালে বাজিমাত করা অসম্ভব।
আসল লড়াই মাউথ অরগ্যানের সাথে বাঁশির।
যাদুঘরের সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েই আছে, সেই কোন সকালবেলা গড়িয়া থেকে মধুকে নিয়ে বেরিয়েছে। যেতে হবে গঙ্গার ওপারে। আজকে রিহার্সাল, ফাইনাল রাউন্ড আগামীকাল। হ্যামলিনের কর্ণধার’রা ঠিক করেছেন যে ফাইনাল রাউন্ডটা লাইভ টেলিকাস্ট হবে। তাতে খরচ অনেকটাই বেড়ে যাবে। কিন্তু টি আর পি যে হারে চড়ছে, তাতে খরচটা জাস্ট লিস্ট অফ দি প্রব্লেমস।
হঠাৎ চোখ চলে গেল। জাদুঘরের দরজার সামনে একটা লোক বাঁশি বিক্রী করছে। ফুটপাতে বসে আছে। সামনে একটা বড়ো ধুলোমাখা লাল শালুর কাপড় পাতা। শালুর ওপরে তা প্রায় ষাট-সত্তরটা ছোটো-বড়ো-মাঝারি বাঁশি। এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, খুব একটা ভালো কোয়ালিটির নয়। যত্ন করে তৈরী করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু ঠিক উৎরোয় নি।
মধুর বেশ অবস্থাপন্ন ঘর, বাবা পেনশনার। মধু নিজেও ব্যাঙ্কে ভদ্রস্থ মাইনের চাকরি করে।
মাউথ অরগ্যান যে ছেলেটা বাজায়, অমিত। বড্ড ভালো। ওর সাথে মধুর বেশ ভাব হয়ে গেছে। মধুর থেকে বয়েসে ছোট, দাদা বলে ডাকে। ফাইনাল রাউন্ডের আগে অব্দি সমস্ত প্রতিযোগীকে এক সাথে তিন মাস থাকতে হয়েছিল, ঘর বাড়ি ছেড়ে। আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হয়েছে, ওরা পাঁচ জন রয়ে গেছে। কিন্তু স্ট্রং কন্টেস্ট্যান্ট হওয়া সত্ত্বেও অমিত আর মধুর বন্ধুত্ব আলাদা করে চোখে পড়ার মত।
অমিতের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ শোচনীয়। বাবা সিনেমা হলে টিকেট কালেক্টর ছিলেন। এখন পুরো পরিবারের রোজগারের ভরসা বলতে শুধু অমিত। মাঝে মধ্যে সিরিয়ালের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে ডাক পড়ে। কিন্তু তা দিয়ে চারজনের সংসার চালানো মুশকিল। বাবা, মা, বোন, অমিত নিজে। 'কে হবে বাংলার হ্যামলিন' এর চ্যাম্পিয়নের প্রাপ্য পাঁচ লাখ টাকা অমিতের দরকার।
মধুর থেকে একটু বেশীই দরকার। মধু সেটা বোঝে, জানে।
মধুর থেকে একটু বেশীই দরকার। মধু সেটা বোঝে, জানে।
কিন্তু মধু কম্পিটিশন ছেড়ে চলে যেতে পারছে না।
না, ওই পাঁচ লাখ টাকার জন্য নয়। সবাই ওই টাকাটার জন্যেই আসে, কিন্তু মধু এসেছে রিয়েলিটি শো’র জন্য। মধু’র রিয়ালিটি শো ভালো লাগে। আগে থেকে স্ক্রিপ্ট লেখা নেই। যেদিনের যেমন পারফরম্যান্স, সেরকম পুরষ্কার, এটা মধুকে নাড়ায়। উত্তেজিত করে। এটা ঠিক যেন খেলা, কোনো সেকেন্ড টেক নেই। যা করার একবারেই করতে হবে। নইলেই তুমি আউট।
এই উত্তেজনাটা মধু ছাড়তে পারবে না। কিছুতেই পারবে না। অমিতের বাবার অসুখ, বোনের বিয়ে - এসবের প্রতি সে সিম্প্যাথেটিক। কিন্তু অমিত’কে সুরের খেলায় হারানোর যে তীব্র অভিঘাত, মাথার ভিতরে হর্মোনের স্পার্ক – এগুলো মধু ছাড়তে পারবে না।
মধু আরেকবার ঘড়ি দেখল, কালকে ফাইনাল, আজকে রিহার্সাল। শুরু হতে এখনও দুঘণ্টা বাকি। দেরী হয়ে যাচ্ছে। তার জন্যে আরো এক ঘন্টা হয়তো ওয়েট করবে। মধু হাত গরম করার সুযোগ পাবে না।
জাদুঘরের সামনের সেই লোকটা বাঁশি নিয়ে কাল হো না হো বাজাচ্ছে। জমছে না। লোকটা খুবই চেষ্টা করছে, কিন্তু হচ্ছে না। পাশ দিয়ে জলের স্রোতের মত অফিস-যাত্রী, স্কুল-পড়ুয়ার দল চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু’একজন যে ঘুরে দেখছে না তা নয়, কিন্তু ওই অব্দি। প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল, লোকটা একটা বাঁশিও বিক্রী করতে পারে নি।
লোকটা বাঁশি নামিয়ে রেখে গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে, টপ টপ করে ঘাম পড়ছে বাঁশির ওপরে। সেটাও মুছছে।
![]() |
http://tinyurl.com/mvn99ga |
মধু'র শুধু অমিতের বাবার রুগ্ন মুখটা মনে পড়ছে। ভাল্লাগছে না। হঠাৎ ট্যাক্সিওলাকে, “নাঃ এতো এগোচ্ছেই না, একটু নেমে দাঁড়াই।” বলে নেমে পড়লো।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বাঁশি বিক্রেতার দিকে।
- “দেখি দাদা? ওই বাঁশিটা দিন তো। ওটা ডি শার্প তো?”
বাঁশি বিক্রেতা মুখ তুলে তাকিয়েছে। মুখে আশার আলো।
- “না মানে ... আমি ঠিক জানি না বাবু। আপনি দেখুন না। আমার কাছে অনেক বাঁশি আছে। তার মধ্যে কোনটা ডি শার্প ......”
- “ঠিক আছে। আপনি ওটাই দিন আমাকে।”
মধুর হাতে চলে এসেছে একটা রংচটা একটু মাঝারি সাইজের বাঁশি। মধুর অভিজ্ঞ চোখ বলছে এই বাঁশির বাঁশটা সিজন্ড। কাঁচা নয়। সাউন্ডটা ফাম্বল করবে না।
এরপর যেটা শুরু হল - মিউজিয়ামের সামনের ট্রাফিক সার্জেন্ট পুলিশ সুজয় সমাদ্দার সেটা আশা করেন নি। রুলিং পার্টির মিছিল চলছে, গাড়ি-মানুষ-হকার নিয়ে ভালোই ঘ্যাঁট পেকেছে। সারাদিন বিরক্তির একশেষ যাবে।
এর মধ্যে মিউজিয়ামের সামনে জনা পঞ্চাশ লোকের একটা জটলা। ভিতর থেকে একটা ফোক টিউন ভেসে আসছে। রেডিও'তে প্রোগ্রাম হচ্ছে বোধ হয়।
সুজয় সমাদ্দার একটু ভুরু কোঁচকালেন। ফুটপাতের রেডিও’র অ্যাতো পরিষ্কার আওয়াজ হয় কি করে? নাকি লোকটা সাউন্ড বক্স বিক্রী করছে? নাকি সত্যি সত্যিই বাঁশি বাজাচ্ছে? নাহ্ তা হতে পারে না। এরকম ভালো বাজনাদার রাস্তায় বসে কেন বাজাবে। ব্যাপারটা এক্সপ্লোর করতে হচ্ছে। সুজয় সমাদ্দারটা হাতের ব্যাটনটা দোলাতে দোলাতে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বাঁশি বিক্রেতা লোকটি অবাক। সকাল থেকে বউনি হয় নি। এই একটা লোক যদি বা এল, বাঁশি নিয়ে বাজাতে শুরু দিল। বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই, কোনো হুঁশ নেই। কিনবে কি কিনবে না বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটা উপকার হয়েছে, লোকটার বাজানোর হাত চমৎকার। তার দোকানের পাশে বেশ ভিড় জমে গেছে। দু-তিন জন হাতে করে কয়েকটা বাঁশি নাড়াচাড়া করছে। বাঁশি বাজাচ্ছে যে লোকটা তাকে চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। সত্যিই ভিড়টা বাড়ছে। দুজন লোক বাঁশির দাম জিজ্ঞেস করেছে। আহা, কি আনন্দ। একটুও দরদাম না করে পকেট থেকে পয়সা বার করে কিনেও নিয়েছে। আরো দু’জন বাঁশি হাতে নিয়ে পরখ করে দেখছে। আর ওই লোকটা বাঁশি বাজিয়েই যাচ্ছে। পাকা হাত বটে।
সুজয় সমাদ্দার দ্রত পায়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে এলেন। গম্ভীর গলা।
- “এই, কি হচ্ছে? ভিড় হাল্কা করুন। রাস্তায় সবাইকে হাঁটার জায়গা করে দিন।”
কেউ একটা ফুট কাটল, “রাস্তায় কি হাঁটার জো আছে স্যার। এ যা বাঁধিয়েছেন, ছাড়াতে সারা দিন লেগে যাবে।”
বাঁশিটা এতোক্ষণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের মত বাজছিল। সুজয় সমাদ্দারের বাঁজখাই গলার সাথে পাল্লা দিয়ে, হঠাৎ গম্ভীর ভরাট আওয়াজের দিকে চলে গেল। স্বভাব যায় না মলে। সুজয় সমাদ্দার এত কিছুর মধ্যেও একটা হাঁক না পেড়ে থাকতে পাড়লেন না, “কে রে?” বাঁশির অপার্থিব সুরের মধ্যে ওরকম রসভঙ্গ করায়, উপস্থিত জনতার চোখের মণি টার্গেট-সিকিং-মিসাইলের মত সুজয় সমাদ্দারের দিকে ঘুরে গেল। তাই দ্বিতীয়বার “কে রে” বলার সময় 'রে' টা কোমল রে হয়ে গেল।
সুজয় সমাদ্দার নিজের কন্ঠের এই অধঃপতনে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয়ে পড়লেন।
ইতিমধ্যে বাঁশির বিক্রির হার আরেকটু বেড়েছে। মোট পাঁচটা বিক্রি হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দুটি বিদেশী হিপি মেয়ে বাঁশি দেখছে। তারা মোটামুটি পছন্দও করে ফেলেছে। মুশকিল হচ্ছে তারা বাঁশিওলা’কে একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছে।
তারপর বোঝা গেল, মুশকিল একটা নয়, দুটো। বাঁশিওলার কাছে খুচরো নেই, আর ওদিকে হিপিদ্বয় পাঁচশো টাকা দিয়ে ফেরত নিতে রাজি নয়। সাত ডলারের কমে কি করে একটা বাঁশি বিক্রি হতে পারে, এ তাদের ধারণার অগম্য।
দুটি সমস্যা আসলে একে অন্যের সমাধান। পৃথিবীতে খুব কম এরকম ঘটে। যখন ঘটে, তখন শত সমস্যা সত্ত্বেও পৃথিবীকে অদম্য সুন্দর মনে হয়।
সুজয় সমাদ্দার নিজের স্কিল সেট আপ্লাই করার আগেই সব সমাধান হয়ে গেল। সুজয় সমাদ্দার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, পাঁচশো টাকা দিয়ে ফুটপাত থেকে বাঁশি? পাগল না রুলিং পার্টি?
মুশকিল হচ্ছে, সুজয় সমাদ্দার নিজের কানকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। এক সাথে দু'দুটো ইন্দ্রিয় কাজ না করলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। সেটা পুলিশের কাজ হলেও মুশকিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটা লোক অ্যাতো ভালো বাজায় কি করে?
সুজয় সমাদ্দার ভেবে সেটা বার করার আগেই মধু বাঁশি নামিয়ে রাখল। টানা প্রায় কুড়ি মিনিট বাজিয়ে মধু একটু হাঁপাচ্ছে। বাঁশি তো, দম লাগিয়ে বাজাতে হয়।
শ্বাস ফিরে পেয়ে বাঁশিওলার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি? কটা হল?”
- “এই মোট এগারোটা।”
সুজয় সমাদ্দার হামলে পড়লেন, “এই না না, বারো’টা। আমাকেও একটা দাও। কলেজে পড়তে একটু আধটু বাজাতাম। আবার চেষ্টা করে দেখি।”
মধু কথা না বাড়িয়ে ট্যাক্সি’র দিকে এগোচ্ছিল। বাঁশিবিক্রেতা কথা বলার অবস্থায় নেই। কুড়ি মিনিটে কেন, সারা দিনে সে বারোটা বাঁশি বিক্রি করতে পারতো কি না সন্দেহ আছে। অ্যাকচুয়েলি, সন্দেহ নেই, পারতো না।
বাঁশিবিক্রেতা লোকটি কিঞ্চিৎ কনফিউজড। সাথে বাচ্চা ছেলেটা, যে বাঁশি বাজায় সে আজ আসে নি। তাই কপালে হুজ্জোতি আছে জানত। কিন্তু আজকে দুটো নতুন একদম অভিজ্ঞতা ঘটেছে তার জীবনে - কুড়ি মিনিটে বারোটা বাঁশি বিক্রি হয়েছে। আর সাদা পোশাকের পুলিশ পয়সা দিয়ে বাঁশি কিনেছে।
মধু ট্যাক্সিতে উঠে গাটা এলিয়ে দিয়েই মুখ খুলল, “গাড়িটা ঘুরিয়ে নিন বিমলদা। শরীরটা ভালো লাগছে না। বাড়ি ফেরত চলে যাই।”
ট্যাক্সিওলা বিমলবাবু বেশ অবাক। পাড়ার ট্যাক্সি। 'কে হবে বাংলার হ্যামলিন' করে মধু পাড়ায় এখন ছোটোখাটো সেলেব্রিটি।
- “সে কি মধু? হ্যামলিনের শুটিং এ যাবে না? রিয়েলিটি শো’র কি হবে?”
মধু কোনো উত্তর দিল না। ফোন করে হ্যামলিন থেকে নাম তুলে নেবে।
সে জানে রিয়েলিটি শো তার জেতা হয়ে গেছে। বারোটা বাঁশি ইস ইকুইভ্যালেন্ট টু বারো হাজার এস এম এস।
--
মধুর হাতে চলে এসেছে একটা রংচটা একটু মাঝারি সাইজের বাঁশি। মধুর অভিজ্ঞ চোখ বলছে এই বাঁশির বাঁশটা সিজন্ড। কাঁচা নয়। সাউন্ডটা ফাম্বল করবে না।
এরপর যেটা শুরু হল - মিউজিয়ামের সামনের ট্রাফিক সার্জেন্ট পুলিশ সুজয় সমাদ্দার সেটা আশা করেন নি। রুলিং পার্টির মিছিল চলছে, গাড়ি-মানুষ-হকার নিয়ে ভালোই ঘ্যাঁট পেকেছে। সারাদিন বিরক্তির একশেষ যাবে।
এর মধ্যে মিউজিয়ামের সামনে জনা পঞ্চাশ লোকের একটা জটলা। ভিতর থেকে একটা ফোক টিউন ভেসে আসছে। রেডিও'তে প্রোগ্রাম হচ্ছে বোধ হয়।
সুজয় সমাদ্দার একটু ভুরু কোঁচকালেন। ফুটপাতের রেডিও’র অ্যাতো পরিষ্কার আওয়াজ হয় কি করে? নাকি লোকটা সাউন্ড বক্স বিক্রী করছে? নাকি সত্যি সত্যিই বাঁশি বাজাচ্ছে? নাহ্ তা হতে পারে না। এরকম ভালো বাজনাদার রাস্তায় বসে কেন বাজাবে। ব্যাপারটা এক্সপ্লোর করতে হচ্ছে। সুজয় সমাদ্দারটা হাতের ব্যাটনটা দোলাতে দোলাতে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বাঁশি বিক্রেতা লোকটি অবাক। সকাল থেকে বউনি হয় নি। এই একটা লোক যদি বা এল, বাঁশি নিয়ে বাজাতে শুরু দিল। বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই, কোনো হুঁশ নেই। কিনবে কি কিনবে না বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটা উপকার হয়েছে, লোকটার বাজানোর হাত চমৎকার। তার দোকানের পাশে বেশ ভিড় জমে গেছে। দু-তিন জন হাতে করে কয়েকটা বাঁশি নাড়াচাড়া করছে। বাঁশি বাজাচ্ছে যে লোকটা তাকে চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। সত্যিই ভিড়টা বাড়ছে। দুজন লোক বাঁশির দাম জিজ্ঞেস করেছে। আহা, কি আনন্দ। একটুও দরদাম না করে পকেট থেকে পয়সা বার করে কিনেও নিয়েছে। আরো দু’জন বাঁশি হাতে নিয়ে পরখ করে দেখছে। আর ওই লোকটা বাঁশি বাজিয়েই যাচ্ছে। পাকা হাত বটে।
সুজয় সমাদ্দার দ্রত পায়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে এলেন। গম্ভীর গলা।
- “এই, কি হচ্ছে? ভিড় হাল্কা করুন। রাস্তায় সবাইকে হাঁটার জায়গা করে দিন।”
কেউ একটা ফুট কাটল, “রাস্তায় কি হাঁটার জো আছে স্যার। এ যা বাঁধিয়েছেন, ছাড়াতে সারা দিন লেগে যাবে।”
বাঁশিটা এতোক্ষণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের মত বাজছিল। সুজয় সমাদ্দারের বাঁজখাই গলার সাথে পাল্লা দিয়ে, হঠাৎ গম্ভীর ভরাট আওয়াজের দিকে চলে গেল। স্বভাব যায় না মলে। সুজয় সমাদ্দার এত কিছুর মধ্যেও একটা হাঁক না পেড়ে থাকতে পাড়লেন না, “কে রে?” বাঁশির অপার্থিব সুরের মধ্যে ওরকম রসভঙ্গ করায়, উপস্থিত জনতার চোখের মণি টার্গেট-সিকিং-মিসাইলের মত সুজয় সমাদ্দারের দিকে ঘুরে গেল। তাই দ্বিতীয়বার “কে রে” বলার সময় 'রে' টা কোমল রে হয়ে গেল।
সুজয় সমাদ্দার নিজের কন্ঠের এই অধঃপতনে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয়ে পড়লেন।
ইতিমধ্যে বাঁশির বিক্রির হার আরেকটু বেড়েছে। মোট পাঁচটা বিক্রি হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দুটি বিদেশী হিপি মেয়ে বাঁশি দেখছে। তারা মোটামুটি পছন্দও করে ফেলেছে। মুশকিল হচ্ছে তারা বাঁশিওলা’কে একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছে।
তারপর বোঝা গেল, মুশকিল একটা নয়, দুটো। বাঁশিওলার কাছে খুচরো নেই, আর ওদিকে হিপিদ্বয় পাঁচশো টাকা দিয়ে ফেরত নিতে রাজি নয়। সাত ডলারের কমে কি করে একটা বাঁশি বিক্রি হতে পারে, এ তাদের ধারণার অগম্য।
দুটি সমস্যা আসলে একে অন্যের সমাধান। পৃথিবীতে খুব কম এরকম ঘটে। যখন ঘটে, তখন শত সমস্যা সত্ত্বেও পৃথিবীকে অদম্য সুন্দর মনে হয়।
সুজয় সমাদ্দার নিজের স্কিল সেট আপ্লাই করার আগেই সব সমাধান হয়ে গেল। সুজয় সমাদ্দার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, পাঁচশো টাকা দিয়ে ফুটপাত থেকে বাঁশি? পাগল না রুলিং পার্টি?
মুশকিল হচ্ছে, সুজয় সমাদ্দার নিজের কানকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। এক সাথে দু'দুটো ইন্দ্রিয় কাজ না করলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। সেটা পুলিশের কাজ হলেও মুশকিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটা লোক অ্যাতো ভালো বাজায় কি করে?
সুজয় সমাদ্দার ভেবে সেটা বার করার আগেই মধু বাঁশি নামিয়ে রাখল। টানা প্রায় কুড়ি মিনিট বাজিয়ে মধু একটু হাঁপাচ্ছে। বাঁশি তো, দম লাগিয়ে বাজাতে হয়।
শ্বাস ফিরে পেয়ে বাঁশিওলার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি? কটা হল?”
- “এই মোট এগারোটা।”
সুজয় সমাদ্দার হামলে পড়লেন, “এই না না, বারো’টা। আমাকেও একটা দাও। কলেজে পড়তে একটু আধটু বাজাতাম। আবার চেষ্টা করে দেখি।”
মধু কথা না বাড়িয়ে ট্যাক্সি’র দিকে এগোচ্ছিল। বাঁশিবিক্রেতা কথা বলার অবস্থায় নেই। কুড়ি মিনিটে কেন, সারা দিনে সে বারোটা বাঁশি বিক্রি করতে পারতো কি না সন্দেহ আছে। অ্যাকচুয়েলি, সন্দেহ নেই, পারতো না।
বাঁশিবিক্রেতা লোকটি কিঞ্চিৎ কনফিউজড। সাথে বাচ্চা ছেলেটা, যে বাঁশি বাজায় সে আজ আসে নি। তাই কপালে হুজ্জোতি আছে জানত। কিন্তু আজকে দুটো নতুন একদম অভিজ্ঞতা ঘটেছে তার জীবনে - কুড়ি মিনিটে বারোটা বাঁশি বিক্রি হয়েছে। আর সাদা পোশাকের পুলিশ পয়সা দিয়ে বাঁশি কিনেছে।
মধু ট্যাক্সিতে উঠে গাটা এলিয়ে দিয়েই মুখ খুলল, “গাড়িটা ঘুরিয়ে নিন বিমলদা। শরীরটা ভালো লাগছে না। বাড়ি ফেরত চলে যাই।”
ট্যাক্সিওলা বিমলবাবু বেশ অবাক। পাড়ার ট্যাক্সি। 'কে হবে বাংলার হ্যামলিন' করে মধু পাড়ায় এখন ছোটোখাটো সেলেব্রিটি।
- “সে কি মধু? হ্যামলিনের শুটিং এ যাবে না? রিয়েলিটি শো’র কি হবে?”
মধু কোনো উত্তর দিল না। ফোন করে হ্যামলিন থেকে নাম তুলে নেবে।
সে জানে রিয়েলিটি শো তার জেতা হয়ে গেছে। বারোটা বাঁশি ইস ইকুইভ্যালেন্ট টু বারো হাজার এস এম এস।
--
adbhut. anobydyo.
ReplyDelete*anobodyo. asadharon.
DeleteStatistics bolchhe sara France e ekjon i amar lekha pore :)
DeleteTin bar porlam - abar porbo .......bhishon bhalo ....ANIRBAN RAY
Deletekhub bhalo laglo re
ReplyDeleteKhakor khakor khak ..
Deletekhub bhalo hoyechhe.........darun laglo.....khonchakhunchi karar jaigai nei............
ReplyDelete:)
Deleteসাবাস! আদ্যন্ত আবছা হাসির প্যাকেটে একটা মানবিক মুখ। অসাধারণ্ কথাটা ক্লিশে শোনাবে। তাই আবার বলি, সাবাস!
ReplyDeletekhnik :)
DeleteBhalo, khub bhalo..choto galper sab guun ache..!
ReplyDeleteasadharan
ReplyDelete:)
Deleteবাহ বেশ !
ReplyDelete:)
Deleteভালো লাগলো জয়দা...
ReplyDelete:)
DeleteDuranto idea.
ReplyDeleteKintu duto kaarone golper baandhuni expectation fulfil koreni :-
i) Final round-er aage sadya shesh hoaa tinmaas chokhe poraar moto bandhutwa niye ghar-baari chhere eksaathe thaakbaar poreo AMIT-er MADHU-ke chenaa chenaa laagaa ebong AMIT-ke identify korte MADHU-er eto deri hoaa, jekhaane oraa dujon-ee holo final-er real contender.
ii) Final-er live telecast shuru hobaar aadh ghontaa aageo needy AMIT-er footpath-e bose baanshi bikri koraa.
ShankarDa, abar detailed review! Ami elated. asole sesher amit ar prothomer amit alada chhilo. banshi'olar nam amit haoa'ta nehat'i somapoton.
Deletekintu tomar comment ar aro oneker offline comment peye bujhte parchhi - byaparta koron johar type melodrama hoye gachhe .. tai sesher amit nam'ta muchhe dilam ..
Valo
ReplyDeleteঅতীব সুন্দর। :)
ReplyDeleteখারাপ লাগলেও একই রকম সোচ্চার হয়ে বলবেন অরিজিত। আপানাদের সকলের ইনপুট্স দরকার।
Delete