Sunday, September 8, 2013

আঁচিল

সঙ্ঘমিত্রা দত্ত। ছাব্বিশ, স্ট্রীটস্মার্ট, ঝকঝকে। সোনোডাইন R&D ল্যাবে রিসার্চার। তার গবেষণার বিষয় ওয়ারলেস স্পীকার। কলকাতায় ওই তো হাতে গোনা দুয়েকটা প্রোডাক্ট কোম্পানী আছে।
মেয়ে অ্যাম্বিশাস, পরিশ্রমী। মাত্র তিন বছরের ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে ইতিমধ্যেই মডিউল লিডার। বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না বলে কলকাতায় থেকেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি খড়দায়। প্রতিদিন যাতায়াত।
বন্ধুরা সব বাইরে পড়তে গিয়ে থেকে গেল, সঙ্ঘমিত্রা এক বছরের মধ্যেই, সাঁইসাঁই করে মাস্টার ডিগ্রী খতম করে, কলকাতা ফেরত। বাংলার বাইরে থাকা আর দেশের বাইরে থাকা একই ব্যাপার। ব্যাঙ্গালুরু, নয়ডা সে যাবে না।

বাড়ি ফিরে এসেছে বলে মিত্রা মা-বাবার খুব বাধ্য মেয়ে এরকমটা ভাবলে ভুল হবে।

কেমন? শুনুন তাহলে।
এই সেদিন বাড়ি ফিরে দেখল মা সলুজেঠুর সাথে গল্প করছে। সলুজেঠু সোদপুরে থাকেন, বহুদিনের পারিবারিক বন্ধুত্ব। বংশপরম্পরায় মিত্রাদের বাড়ির গয়না তৈরী করেন। ঠাকুমা আর মার বিয়ের গয়না করেছেন। মিত্রার বেলায় তো সেই অন্নপ্রাশনের আংটি থেকে শুরু। এক ভরির হাল্কা দুল থেকে ভারী সাতনরী হার, সবই সলুজেঠুর এক্সপার্টিজের মধ্যে পড়ে।
তো ইদানীং মা আর ঠাকুমা মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। নাকছাবি পরাবে, তাই নাক ফুটো করতে হবে। মিত্রা সটান না বলে দিয়েছে। মিত্রাকে আপনারা ভুল বুঝবেন না। খুব ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিয়েছে। মিত্রাকে দেখলে আপনারাও ওর সাথে সহমত হবেন। নাকের পাশে ওরকম আখাম্বা একটা আঁচিল নিয়ে নাকছাবি পরা সম্ভব নয়। জাস্ট সম্ভব নয়।

ষড়যন্ত্র এতেই শেষ নয়। দুজনে মিলে রীতিমত প্ল্যান করে একটা অডিও সিডি জন্মদিনে উপহার দিয়েছে। রক্তকরবী। কভারে নন্দিনীর ভূমিকায় তৃপ্তি মিত্র, গোল সুস্পষ্ট আঁচিল ও নাকছাবি। মীরজাফর সলুজেঠু সেটা আবার কাকে দিয়ে জানি কলকাতা থেকে আনিয়েছে।

যন্ত্রণা।

তৃপ্তি মিত্র ক্যারি করতে পারেন, মিত্রা পারে না। ব্যস্‌, মিটে গেল। ইন ফ্যাক্ট, ওটা তো শুধুই একটা ছবি, সামনা সামনি কোনো দিন দেখলে তাও বা বোঝা যেত ভদ্রমহিলা কি টেকনিকে ম্যানেজ করেন। মিত্রার সেই সৌভাগ্য হয় নি। নাটকের জগতের মানুষের সাথে টেকনিক্যাল প্রফেশনালকে এক করে ফেললে চলবে? আফটার অল, রাস্তাঘাটে লোকে তো মিত্রাকেই দেখে হাসাহাসি করবে, নাকি?

তৃপ্তি মিত্র - "রাগ অনুরাগ" (http://tinyurl.com/kxvwyr9)

মিত্রা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে তার সিদ্ধান্ত।
- মা, তোমায় যে স্মার্টফোনটা গতপুজোয় কিনে দিলাম তাতে ডেটটা দেখো এটা ২০১৩। ২০১৩ সালে নাকছাবি আউট-অফ-ফ্যাশন, গট ইট?
- আহা, একবার গড়িয়ে নিয়ে দেখই না। ভালো না লাগলে ভেঙ্গে অন্য কিছু করে নিবি।
- অফিসের R&D করতেই জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে, তো আবার গয়না বানিয়ে ... তারপর গলিয়ে ...... নাঃ, ওসব গয়নার R&D আমার দ্বারা হবে না। তুমি সলুজেঠুকে মানা করে দাও প্লিজ।
তাকে দিয়ে জোর করে কোনো কাজ করানো সম্ভব নয় সেটা সবাই জানে, মা তো হাড়ে হাড়ে জানে। সুতরাং আর কোনো টেনশন নেই।

আজকে প্রোফেসর স্বপ্না চৌধুরীর সাথে দেখা করতে আই আই টি কেজিপি যেতে হবে। হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স।
ওয়ারলেস স্পীকারে হাই-ফ্রিকোয়েন্সি মিউজিক স্যাম্পল করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে, তাই নতুন ধরনের ডিজিটাল ফিল্টার ডিজাইন করতে হবে। সঙ্ঘমিত্রার বস্‌ স্বপ্না চৌধুরীর এক্স-স্টুডেন্ট। বসের অনুরোধে প্রোফেসর চৌধুরী সঙ্ঘমিত্রার ডিজাইনটা রিভিউ করে দিতে রাজি হয়েছেন। তাড়াহুড়ো করে গুগলে ভদ্রমহিলার প্রোফাইলটা দেখা হয় নি, সটান দেখা করতে চলে এসেছে মিত্রা।

হাল্কা নক্‌ করে ঘরে ঢুকে পড়ল সঙ্ঘমিত্রা। স্বপ্না চৌধুরী বেশ বয়স্ক, নিশ্চয়ই রিটায়ার্ড এবং এক্সটেনশনে আছেন।
হাতে নোয়া-শাখা-পলা আর ভীষণ sober একটা ঘিয়ে রঙের শাড়ি। শীর্ণকায়া। মাথায় সরু সিঁদুরের টানা দাগ। চট্‌জলদি ঘর থেকে বেরোনোর সময় কোনোরকমে পরা সিঁদুর নয়, বেশ যত্ন করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে আঁকা। একটু হাল্কা হয়ে আসা চুলের মধ্যে রূপোলী ঝিলিক উঁকি দিচ্ছে। চোখের কোণে সামান্য ক্রো'স ফিট।

স্বপ্না চৌধুরীর সামনে বিশাল অর্ধচন্দ্রাকৃতি টেবিল। টেবিলের এপাশে কয়েকজন অপেক্ষাকৃত কমবয়েসী ফ্যাকাল্টি। শুনে টুনে যা বোঝা যাচ্ছে, সামনের ফেব্রুয়ারীতে ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট একটা ইন্ট্যারন্যাশনাল কনফারেন্স অর্গানাইজ করবে। এই ফ্যাকাল্টিরা সেই কনফারেন্সের অফিসিয়াল অর্গানাইজার। তারই ব্যবস্থাপনা করতে তাঁরা প্রফেসর চৌধুরীর সাহায্য চান। যদিও রিটায়ার্ড, বিদেশের কিছু রিসার্চ ল্যাবের বাঘা বাঘা প্রোফেসরের সাথে স্বপ্না চৌধুরীর কোলাবরেশন ও জয়েন্ট পেপার রয়েছে। তো ম্যাডাম বললে তাঁরা হয়তো কী-নোট স্পীচ দিতে রাজী হয়ে যাবেন।
স্বপ্না চৌধুরী হাতের ইশারায় সঙ্ঘমিত্রাকে পেছনের সারিতে বসতে বললেন।

দ্যাখো আমি বললে অনেকেই হয়তো রাজী হয়ে যাবে। অনেক দিনের আলাপ পরিচয়। অনুরোধ ফেলতে পারবে না। কিন্তু তোমরা তো একটু অন্য ভাবে ভাবতে পারো। ধরো, ইওরোপ আর আমেরিকায় এই মুহূর্তে যে সব ভারতীয় ছাত্র পি. এইচ. ডি. আর পোস্টডক্টরেট করছে, তাদের এমনিতেই দেশে ফেরার একটা টান থাকে। তাদের মধ্যে বেশীরভাগই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেশের বাইরে রিসার্চ করতে গেছে। ইয়ং হতে পারে, বাট দে আর ফুল অফ আইডিয়াজ্‌। আমার মত বুড়ো প্রোফেসরদের পিছনে ধাওয়া না করে তোমরা বরং ওদেরকে রিচ করার চেষ্টা কর।

পরের দুঘন্টায় স্বপ্না চৌধুরী তিনটে কাজ করলেন।
মিত্রার সমস্যা ও সমাধান শুনে, মিত্রার এঁকে আনা ব্লক ডায়াগ্রামে ছোট্টো দুটো ডিসিশন রম্বস ঢুকিয়ে দিলেন। মিত্রার উৎসাহ দেখে ওকে ডিজিটাল সিগন্যাল ল্যাবে নিয়ে গিয়ে গ্লোবাল ইনোভেশন কম্পিটিশনে তাঁর দুটি ডক্টরেট স্টুডেন্টের প্রোজেক্ট জয়েন্টলি সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছে, সেটা দেখালেন। মিত্রাকে হাত ধরে গেস্ট হাউসে মাছের ঝোল ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। সোজা কথা - ছাত্রের ছাত্রী, মানে নাতনি।

সেই দুঘন্টাতেই মিত্রা চারটে কাজ করল। ওপরের তিনটে কাজ, প্লাস আর একটা। ফাঁক পেলেই স্বপ্না চৌধুরীর নাকের বাঁপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেন্টাল নোট করে নেওয়া।
সলিটারী ডায়মন্ডের সিম্পল নাকছাবি।
আর নাকের পাশে একটা বড়ো আঁচিল।
নন্দিনী। রক্তকরবী। অবিকল।

শাঁওলী মিত্র - http://tinyurl.com/mcxm64m
ডানলপ থেকে খড়দা ছয় টাকা ভাড়া। সঙ্ঘমিত্রা ফেরার সময় ডানলপে বাসে চার টাকার টিকিট কাটল। খড়দা ছয় টাকা, চার টাকায় সোদপুর। সলুজেঠুর বাড়ি হয়ে যেতে হবে। পুজো ঘাড়ের ওপর চলে আসছে, নাকছাবির মডেলটা ফাইনাল করে ফেলা দরকার।

11 comments:

  1. Replies
    1. thik hay .. porer bar gulote chesta korbo .. It's good to know that I've set up a high expectation :-)

      Delete
  2. উচ্চাশা এত বাড়িয়ে দিয়েছিস যে এতে মন ভরলো না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. উরেব্বাস, পাঠক কুল তো বেশ ভোকাল। বেশ ভালো লাগছে। সমালোচনা না হলে হান্ড্রেডথ্‌ সেঞ্চুরী অব্দি পৌঁছব কি করে?

      Delete
  3. অনি,আমার তো মন্দ লাগে নি। খুবই ভালো লেগেছে। তবে আমার মনে হয় এই গল্পে নাকছাবির জন্যে নিমরাজি থেকে রাজি হওয়ার পেছনে আরো কিছু inspirational গল্প add করলে হয়ত আরো ভালো হতো। কারণ মিত্রার মানসিক গঠন এবং জেদ এর যেরকম বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল তাতে একটা নাকছাবি এর জন্যে হুট করে রাজি হওয়াটা অত সহজ নয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. পয়েন্ট টেকেন সোম। তবে কিনা মিত্রাদের দেব-দেবতারা অব্দি বুঝতে পারেন না, তো আমি কোন ছার!

      গপ্পের সাইজ আর একটু বাড়াতে পারলে মন্দ হত না। সত্যিই স্বপ্না আর মিত্রার কথোপকথনটা আরো একটু এগোনো উচিত ছিল।

      Delete
  4. আমার কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে। ইমপ্রেস করতে বেশি কিছু লাগেনা।
    -- সব্যসাচী

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক, কি যে লাগে সেটা কেউ জানে না। আর ওটার জন্যেই মজাটা টিকে আছে।

      বাই দ্য ওয়ে, কোন সব্যসাচী সেটা বুঝলাম না, উত্তমকুমার নয় এটুকু শিওর। তাহলে হয় জুনিয়র নইলে ক্লাসমেট।

      আর একদম নতুন কেউ হলে এক্সট্রা স্বাগতম!

      Delete
  5. আমার তো বেশ লাগলো। চাঁচাছোলা ভাষাতেই ভালো সাহিত্য হয়। একটাই কথা: Professor এর নাম এবং বর্ণনা নির্ভুল খালি পদবিতেই হোচট খাচ্ছিলাম; Banerjee হলেই ষোলকলা পূর্ণ হত :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঈশারা দিয়ে রেখেছিলাম, বাকিটা পাঠক বুঝবেন। এই যেমন আপনি বুঝেছেন।

      Delete