আবার সে এসেছে ফিরিয়া। না, পাগলা দাশু নয়, চুপ-কথা। লেখবার বিষয় হু হু করে কমে আসছে। চোখ বুঝলেই কানের ভেতরে গান ভনভন করছে, শিলাজিতের গলায় “আমার আর লেখক হওয়া হল না/ হেহে হেহে/ হে হে”।
এই সময় সাধারণ মানুষ সাধারণতঃ উদাহরণ খোঁজে। এমন কেউ যাকে দেখে শেখা যায়, ঠিক যেমন ছোটোবেলায় পঞ্চু হিসু দিয়ে কাটাকাটি খেলা শিখিয়েছিল। কিন্তু এখন পঞ্চু কোথায় জানি না। অগত্যা অনেক খুঁজে পেতে, দুপাত্তর চড়িয়ে আমি পথ ধরলাম তিন জনের - মিস্টার তারাপদ রায়, মিস্টার নারায়ণ স্যান্যাল আর মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যঃ অনির্বাণ দত্ত চৌধুরী লিচ্চয় ফেমিনিস্ট, এবং সেই কারণে মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটা লিখেছে বলে যারা ফিসফিস করছেন, তাদের উদ্দেশ্যে জানাই “তু মরবি তু মরে যা/ ইক্কেবারে মরে যা/ হিথায় তুরে ...”
খুব মন দিয়ে ভাবলাম, কি নিয়ে লেখা যায়। মানে কিছু একটা লেখা যায়। শেষমেশ ট্রাভেলগ। প্যাটার্ন হচ্ছে কর্পোরেট ইস্টাইল। বুলেট পয়েন্টস। টু দ্য পয়েন্ট। সব’ই পয়েন্ট, থুরি সব’ই মায়া।
জায়গার নাম রোম।
১) আগে যা ঘটেছিলঃ
বাংলা বা অন্য যে কোনো ভাষার টিভি সিরিয়াল থেকে কনসেপ্ট’টা টোকা। বহু বহু বছর আগে, সেই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রথম বার রোম গেসলাম। ছোট্টো যাত্রা জুরিখ থেকে ঘন্টা দেড়েকের ফ্লাইট। আমার বাজেটে ঘোড়ায় করে যাওয়া সম্ভব নয়, অগত্যা। তো এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছি, চেক-ইন ডান। দু’ঘন্টা পরে ফ্লাইট। বিশ্বজয়ীর মত মাথায় ফেল্ট হ্যাট পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিয়ার, কফি, চকোলেট পেঁদিয়ে, “এই তো জীবন, যাক না ... বেয়ারা চালাও ফোয়ারা” গুনগুন করছি, আর ভাবছি মনটা খচখচ করছে কেন? পুরোনো প্রেমিকার কথা মনে পড়ছে কি? না তো। ঘুরতে ঘুরতে আবার সুইস এয়ারের কাউন্টারের সামনে এসে পড়েছি। আর তখনি জটায়ু’র ভাষায় – দশ হাজার ভোল্টের স্পার্ক।
ওই যে চেক-ইন করলাম, সেই চেক ইন ব্যাগেজের ওপরের পকেটে আমার পাসপোর্ট’টি অধিষ্ঠান করছে।
ওই যে চেক-ইন করলাম, সেই চেক ইন ব্যাগেজের ওপরের পকেটে আমার পাসপোর্ট’টি অধিষ্ঠান করছে।
এরপরে কি করে সুইস এয়ার কতৃপক্ষ সেটাকে লস্ট ব্যাগেজ ঘোষণা করে ঘুরিয়ে আনলেন, গেট বন্ধ হওয়ার দশ মিনিট আগে একাকী সেই ব্যাগ সূর্যোদয়ের মত ‘লস্ট ব্যাগেজ কনভেয়ার বেল্টে’ আবির্ভূত হল, এবং সুইস এয়ারের একান্ত বদান্যতায় আমি প্লেনের গেট খটখট করে উঠে পড়লুম, সেটা উহ্য থাক।
শুধু যেটা বলার, সেটা হচ্ছে, প্লেনে উঠে সিটে বসে পরিষ্কার শুনলাম, অজিতেশ বলছেন, “এটাই তো জীবন কালীনাথ”।
২) বাংলাদেশীঃ
এটা অবশ্য ঠিক রোম স্পেসিফিক নয়। সারা ইতালি’তে কোনো বাঙ্গালীর পেটের সমস্যা হলেও হতে পারে, কিন্তু ভাষা সমস্যার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। রাস্তায় চলতে চলতে একটু কান পাতলেই বুঝতে পারবেন। ছোটোবেলায় কখনো রাসের মেলায় গেছেন? প্লাস্টিকের কুকুর, একটা পাতলা প্লাস্টিকের পাইপ সেই কুকুরের পেট থেকে হাতে উঠে এসেছে, শেষমেশ হাতে একটা পাম্প করার যন্ত্র। পাম্প করলেই মাটিতে কুকুরটা লাফাচ্ছে, মাত্র দু’টাকা দাম।
মা কিছুতেই কিনে দিচ্ছে না।
মনে পড়ছে কি?
সেই সেম জিনিস ভ্যাটিকান সিটি’র সামনে আপনি দেখবেন আর মুগ্ধ হয়ে ভাববেন, বাব্বা এটার দু ইউরো দাম। হয়তো মুখ ফস্কে বলে ফেলবেন। আর শুনতে পাবেন, “দ্যাশ হইলে আপনার পয়সা দেওন লাগতো না। ফিরি দিয়া দিতাম।”
যারা ভাবছেন, বাংলাদেশী মানুষদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবো বলে এই বুলেট, তাদের উদ্দেশ্যে অন্য বুলেট ছাড়তে ইচ্ছে করছে। এটা ভালো ভাবে বাঁচার ইচ্ছে বই আর কিছু নয়। ঠিক যে কারণে সহস্র আই টি ইঞ্জিনীয়র অন-সাইটে যায়, ঠিক যে কারণে মোটা হাইক নিয়ে বাঙ্গালী ব্যাঙ্গালোর-মুম্বই পাড়ি দেয় আর ঠিক যে কারণে ইন্টিগ্রেটেড এম-এস-সি পি-এইচ-ডি তে ভর্তি হয়ে লোকে এম-এস-সির পরেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
![]() |
বাড়ি বরিশাল |
মহম্মদ জাফর ইকবাল এই শেষ বিষয়ে অসাধারণ একটি রচনা লিখেছিলেন - “আমেরিকা নিয়ে এক ডজন” http://www.ebanglalibrary.com/muhammedzafariqbal/?p=56
৩) স্প্যানিশ স্টেপ্সঃ
রোমে ফেরত আসা যাক। সকাল সাড়ে পাঁচটার প্রথম মেট্রো চেপে, ম্যাজিক আওয়ারস্ এর স্বাদ নিতে যে যে জায়গায় ঢুঁ মারলাম, তার মধ্যে একটা হল স্প্যানিশ স্টেপ্স। কি ভাবে তৈরী হল, খায় না মাথা দ্যায় সেগুলো প্লিজ গুগল করে নেবেন। বরং ২টো ছবি দেখাই।
অত সকালে আশা করেছিলাম পুরো এলাকাটাই হাত-কাটা আপেলের মত আমার দখলে থাকবে। বাস্তবে দেখা গেল পরিস্থিতি ভিন্ন। আমার আগেই প্রতিযোগীরা প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র সহযোগে লড়াই শুরু করে দিয়েছেন। একটা ভালো ছবি তোলার জন্য মানুষকে যে কষ্ট করতে হয়, সেটা পুনরায় প্রমাণিত হল।
রোমের স্কাই-লাইন দেখতে পাব, এই আশা নিয়ে গেছিলাম। যেটা এক্সট্রা পেলাম, সেটা হল হাজার হাজার পাখির ঝাঁক। অসম্ভব দ্রুত গতিতে হাজারে হাজারে পাখি নিজেদের আপেক্ষিক দূরত্ব স্থির রেখে, মাঝে মাঝেই শার্প টার্ন নিয়ে, বেশ জটিল একটা পথে রোমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত উরে বেড়াচ্ছে। না আছে তাদের মোশন সেন্সর, না আছে ব্যাকভিউ মিরর, না আছে টমটম, না আছে কোনো রেড লাইট। পুরো আকাশটাই ওদের। নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি না করে কি করে এটা করা সম্ভব এটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর কোনো না কোনো রিসার্চ গ্রুপের গবেষণার বিষয়। আমি নিশ্চিত, খোঁজ করলে জানা যাবে এই গবেষক’রাও ট্রাফিক নিয়ম ভাঙ্গেন।
![]() |
ভোরবেলায় চ্যালেঞ্জ |
হয় আপনার খুব ভালো লাগবে, অথবা যন্ত্রণা হবে। হিটলারের বহু জমানা আগে মানুষ কিভাবে স্ট্রাটেজিক্যালি স্টেট-স্পনসর্ড পদ্ধতিতে মানুষ মারতো, মৃত্যুদৃশ্য দেখে মজা পেত, হাততালি দিত – এসবে আপনার ইন্টারেস্ট না থাকলে কলোসিয়ামে ঢুকে মজা পাবেন না।
৮০ এডি তে ওই সাইজের একটা চারতলা ওপেন-এয়ার স্টেডিয়াম তৈরী করা, তারপরে বিভিন্ন শতাব্দী জুড়ে তার ভাঙ্গা-গড়া এবং শেষমেশ সায়েন্টিফিক রেস্টোরেশন। অনেকক্ষণ ঘুরে বাইরে বেরিয়ে যখন শুনতে পাবেন “হক্কাল থেইক্যা হালায় একটাও পানিনি বিক্কিরি হয় নাই”, তখন বুঝতে পারবেন আপনি ফের একবিংশ শতাব্দীতে ফেরত চলে এসেছেন।
৫) ট্রেভি ফাউন্টেনঃ
নিয়ম মেনে চললে সারা দিন ধরে রোম ঘুরে টুরে, সাঁঝবেলায় ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনে বসে আপনি হয় বিয়ার খাবেন, অথবা গরম পাস্তা নামিয়ে জেলাটো নামক শুদ্ধ আইস্ক্রিম সহযোগে ডিনার করবেন। মুশকিল হচ্ছে নিয়মটা খুব’ই ভালো, কিন্তু এই নিয়ম যবে তৈরী হয়েছিল, সে সময়ের তুলনায়, এই মর্ত্যধামে প্রায় চারশো কোটি বেশী মানুষ ঘোরাফেরা করে। তাই আপনার ওই গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে ট্রেভির অপার্থিব আলো-ভরা-জলের-স্রোত দেখতে ভালো নাও লাগতে পারে।
অতঃকিম?
হেঁ হেঁ হেঁ, ব্যাক টু ম্যাজিক আওয়ারস্।
আপনি এবং কয়েকটি দ্রুতগামী পাখি। প্লিজ পাখির নাম জিজ্ঞেস করবেন না, ফাইনম্যানের পিতাশ্রীর কথা মনে করিয়ে দেব। একটা পাখির নাম জানলে, বেশ কয়েক’টা ভাষায় তার নাম জানলে, তুমি কিন্তু পাখিটা সমন্ধে আসলে কিছুই জানলে না।
darun laglo!!
ReplyDeletechamatkar...:)
ReplyDeleteগুড, পরের সংখ্যায় সমাপ্য :)
DeleteJio....
ReplyDeleteতোকেও জিও ...
DeleteAsambhav bhalo.publish korle loke poisa diye kine porbe.just too good.apekkhai thaklam.
ReplyDeleteবলছিস? পয়সা হবে? বেশ বেশ। ঠাকুর বলে গেছেন, "টাকা কথা রাখে"।
Deleteপড়তে পড়তে আর একজনের কথাও মনে আসছে। সৈয়দ মুজতবা আলির ভ্রমণ বর্ণনার মতই ক্রিসপি আর সুস্বাদু।
ReplyDeleteব্যস্, বেশী বার খেয়ে গেলাম।
Delete